সুদানের দারফুর অঞ্চলের শহর আল-ফাশের এখন এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের কেন্দ্রবিন্দু। আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) শহরটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে চলছে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ। জাতিসংঘের হিসাবে, শুধুমাত্র গত কয়েক সপ্তাহেই শত শত নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন, বাস্তুচ্যুত হয়েছেন প্রায় ১২ লাখ মানুষ।
একসময়ের প্রাণবন্ত শহর আল-ফাশের এখন মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতরের তথ্যমতে, প্রতিদিনই ঘটছে বেসামরিক নাগরিক হত্যা, নারীদের ওপর যৌন সহিংসতা, ঘরবাড়ি, আশ্রয়কেন্দ্র ও শরণার্থী ক্যাম্পে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার মতো নৃশংস ঘটনা। স্থানীয় হাসপাতাল ও স্কুলও রক্ষা পায়নি এই বর্বরতার হাত থেকে। শুধু একটি হাসপাতালে ৫০০-রও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
খাদ্য, পানি ও ওষুধের সংকটে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস (MSF) জানিয়েছে, অপুষ্টি ও পানির অভাবে বহু শিশু মারা যাচ্ছে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) সতর্ক করেছে—তাৎক্ষণিক মানবিক সহায়তা না বাড়ালে পরিস্থিতি পুরোপুরি দুর্ভিক্ষে রূপ নেবে।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, আরব আমিরাত RSF-কে অস্ত্র, ড্রোন ও অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। চাদ হয়ে এই সরঞ্জামগুলো সুদানে পাচার করা হয়। উদ্দেশ্য—সুদানের স্বর্ণসম্পদ ও বাণিজ্যিক প্রভাবের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। আরব আমিরাত দীর্ঘদিন ধরেই আফ্রিকার হর্ন অঞ্চল ও দারফুরে অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে। RSF নেতা মোহাম্মদ হামদান দাগালো (হেমেদতি)-র সঙ্গে আমিরাতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নতুন নয়। RSF বাহিনীই মূলত দারফুরের স্বর্ণখনি ও সীমান্ত বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণে রাখে, যা থেকে আমিরাত সরাসরি উপকৃত হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।। এমনকি সুদানের সরকারি সেনাবাহিনীও ইউএই’র বিরুদ্ধে ড্রোন হামলায় সহায়তার অভিযোগ তুলেছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও আরও কয়েকটি দেশ বলছে—এই অভিযোগের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত ইউএই’র সঙ্গে অস্ত্র বাণিজ্য স্থগিত রাখা উচিত। তবে ইউএই এসব অভিযোগ সর্বতোভাবে অস্বীকার করেছে।
জাতিসংঘ ও আফ্রিকান ইউনিয়ন জানিয়েছে, সুদানে শান্তি প্রতিষ্ঠার সব প্রচেষ্টা এখন প্রায় ভেস্তে গেছে। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, মিশর ও ইউএই মিলে তিন মাসের মানবিক বিরতির প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয়নি।
২০১৯ সালে একনায়ক ওমর আল-বশিরের পতনের পর, সেনাপ্রধান আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান ও আরএসএফ নেতা মোহাম্মদ হামদান দাগালো (হেমেতি) একসময় ছিলেন সহযোগী। কিন্তু সেনাবাহিনীতে আরএসএফকে একীভূত করা নিয়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সেই দ্বন্দ্ব এখন পুরো দেশকে গৃহযুদ্ধের অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, আল-ফাশের হয়ে উঠেছে গৃহযুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু, আর সেখানে চলছে আধাসামরিক বাহিনীর নৃশংসতার নতুন অধ্যায়—যেখানে মানবতার পরাজয় প্রতিদিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে।