বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে একদিকে ঋণ খেলাপির উচ্চ হার, অন্যদিকে সরকারি ব্যাংকগুলোতে আমানতের রেকর্ড প্রবৃদ্ধি—এই দুই বিপরীতমুখী চিত্রই এখন অর্থনীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ—এই ৯ মাসে রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংকে মোট ৩৪ হাজার ২৫৪ কোটি টাকার নতুন আমানত জমা হয়েছে। অথচ একই সময় পর্যন্ত দেশের মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৪.১৩ শতাংশ—প্রায় ৪ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা—খেলাপি হয়ে পড়েছে, যার মধ্যে ৪৫ শতাংশই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঘাড়ে।
ব্যাংক কর্মকর্তাদের মতে, সুশাসন এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণে গ্রাহকদের আস্থা ফিরছে। অগ্রণী ব্যাংক পিএলসির উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবুল বাশার বলেন, “ব্যাংকগুলো আবার স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরছে। আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।”
জনতা ব্যাংক পিএলসিও খেলাপি ঋণের চাপ থেকে বেরিয়ে আসতে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে। প্রথমবারের মতো কর্মীদের জন্য আমানত সংগ্রহে টার্গেট নির্ধারণ এবং পারফরম্যান্স অনুযায়ী প্রণোদনা চালু করতে যাচ্ছে ব্যাংকটি। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মজিবর রহমান জানান, “একজন কর্মকর্তা নির্ধারিত লক্ষ্য পূরণ করতে পারলে ৫ পয়েন্ট পাবেন, অর্ধেক পূরণে পাবেন আড়াই পয়েন্ট। এসব পয়েন্ট পদোন্নতির ক্ষেত্রেও বিবেচিত হবে। এতে কর্মীদের মধ্যে ব্যক্তিগত অর্জনের উৎসাহ তৈরি হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ ধাপে ধাপে খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, ঋণ অনুমোদনের প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব কমায় পরিস্থিতি কিছুটা স্বচ্ছ হচ্ছে। অর্থনীতিবিদ ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “আগে যেমন ওপর থেকে চাপ এলেই লোন পাস হয়ে যেত, এখন তা হচ্ছে না। নিয়ম মেনে চললে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো আবার শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারবে।”
সরকারি ব্যাংকে আমানতের এই প্রবৃদ্ধির বিপরীতে, জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে আমানত কমেছে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা। এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা।
দুর্নীতি, খেলাপি ও ব্যবস্থাপনাগত চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও গ্রাহকের আস্থা যে এখনও সরকারি ব্যাংকগুলোর প্রতি অটুট রয়েছে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিক আমানত প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যানে। যদি সুশাসনের এ ধারা অব্যাহত থাকে, তবে অর্থনৈতিক কাঠামোতে পরিবর্তন এনে পুনরায় স্থিতিশীলতা ফেরানো সম্ভব—এমনটাই আশা করছে বিশ্লেষকরা।
Leave a Reply