ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে মার্কিন অবস্থান ঘিরে দ্বিধা, বিশ্লেষকরা বলছেন ট্রাম্পের বক্তব্য ‘দোদুল্যমান ও বিপজ্জনক’
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান সংঘাত যখন চরমে, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপরীতমুখী বার্তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
একদিকে তিনি প্রকাশ্যে কূটনৈতিক সমাধানের পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছেন, অন্যদিকে ইঙ্গিত দিচ্ছেন সামরিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনার। এতে প্রশ্ন উঠেছে—যুক্তরাষ্ট্র কি আবারও একটি মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চলেছে?
ট্রাম্পের ‘কূটনীতি না হয় ধ্বংস’ বার্তা
গত সপ্তাহে ট্রাম্প Truth Social-এ এক পোস্টে লেখেন,
“আমরা এখনও কূটনৈতিক সমাধানের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
কিন্তু মাত্র ১৪ ঘণ্টা পর যখন ইসরায়েল ইরানে হামলা শুরু করে, তখন ট্রাম্প বলেন তিনি ইতোমধ্যে ইরানকে ৬০ দিনের সময়সীমা দিয়েছিলেন এবং তা পেরিয়ে গেছে।
পরে রবিবার তিনি আবার লেখেন,
“ইসরায়েল ও ইরানকে চুক্তি করতে হবে—আমার সহায়তায় তা হবেই।”
“তেহরান ছেড়ে দিন”: যুদ্ধ হুমকি নাকি রাজনৈতিক কৌশল?
G7 সম্মেলন শেষে হঠাৎ যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার সময় ট্রাম্প বলেন,
“সবাই যেন দ্রুত তেহরান ত্যাগ করে!”
যদিও অনেকে ধারণা করেছিলেন, তিনি যুদ্ধবিরতির আলোচনায় ফিরেছেন, ট্রাম্প নিজেই বলেন,
“এটি কেবল যুদ্ধবিরতির জন্য নয়, বরং তার চেয়েও বড় কিছু।”
বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের অস্পষ্ট ও উসকানিমূলক বার্তা কেবল ইরান নয়, পুরো মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি জড়িত? ‘চোখের ইশারা’র বিতর্ক
যদিও ট্রাম্প দাবি করেন,
“আজ রাতে ইরানে হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সম্পৃক্ততা নেই,”
তবুও অনেক বিশ্লেষক বলছেন, মার্কিন প্রশাসন আগে থেকেই হামলার পরিকল্পনা সম্পর্কে সচেতন ছিল।
অলি আনসারি, অধ্যাপক, সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয় (স্কটল্যান্ড):
“সময়টা হয়তো চমকপ্রদ ছিল, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই জানত। এক রকম চোখের ইশারাই ছিল।”
রিচার্ড নেফিউ, সাবেক ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল কর্মকর্তা ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক:
“ট্রাম্পের ধারাবাহিকভাবে চুক্তির চেষ্টা ইসরায়েলকে উদ্বিগ্ন করে তোলে। কূটনীতি সফল হওয়ার আগেই ইসরায়েল ঝাঁপিয়ে পড়ে।”
কেলসি ড্যাভেনপোর্ট, Arms Control Association:
“পাবলিকভাবে ট্রাম্প যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিলেন, কিন্তু তার দ্বিধাগ্রস্ত বার্তা ইসরায়েলকে উৎসাহিত করেছে।”
পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্যবস্তু, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া সম্ভব?
ইসরায়েলের হামলায় নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনার উপরের অংশ ধ্বংস হয়েছে। তবে ফোরদো কেন্দ্র, যা পাহাড়ের গভীরে অবস্থিত, এখনো অক্ষত রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন ভূগর্ভস্থ স্থাপনায় হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের Massive Ordnance Penetrator দরকার, যা এখনো ইসরায়েলকে দেওয়া হয়নি।
ড্যাভেনপোর্ট বলেন,
“যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া ইসরায়েলের পক্ষে ফোরদো ধ্বংস করা সম্ভব নয়।”
যুদ্ধ প্রস্তুতি: মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ও যুদ্ধবিমান পাঠানো
যুদ্ধের সম্ভাবনা প্রত্যাখ্যান করলেও যুক্তরাষ্ট্র USS Nimitz যুদ্ধজাহাজ মধ্যপ্রাচ্যে পাঠিয়েছে, এবং বড় সংখ্যক ফুয়েল ট্যাংকার ও যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি স্পষ্ট ইঙ্গিত যে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত রয়েছে, যদিও এখনো সরাসরি লড়াইয়ে জড়ায়নি।
পারমাণবিক উত্তেজনা ও JCPOA ভাঙার ফল
২০১৮ সালে ট্রাম্প JCPOA (পারমাণবিক চুক্তি) থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন, যা বর্তমান পরিস্থিতির অন্যতম কারণ।
এ বিষয়ে নেফিউ বলেন,
“চুক্তিটি ধ্বংস করাই আমাদের আজকের অবস্থানের মূল কারণ।”
IAEA জানায়, ইরান এখন ৬০% পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে—যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ৯০%-এর কাছাকাছি।
মার্কিন কংগ্রেসে যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ বিল
এদিকে, মার্কিন সিনেটর টিম কেইন কংগ্রেসে একটি যুদ্ধ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ প্রস্তাব এনেছেন, যেখানে বলা হয়েছে—
“ইরানের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তখনই যৌক্তিক, যখন তা সরাসরি নিজেদের নিরাপত্তার জন্য আবশ্যক।”
সূত্র আল জাজিরা
Leave a Reply