একদা ঢাকার প্রাণবন্ত জলধারা, আজ দখল ও দূষণের কবলে মৃতপ্রায়। বুড়িগঙ্গা নদী এখন বিষাক্ত কালো পানির এক ধারা, যেখানে মাছ নয়, ভাসছে প্লাস্টিক বোতল আর দুর্গন্ধের ঝাঁঝ। নদীর ১৫ ফুট গভীরেও মিলছে প্লাস্টিক বর্জ্য—চিত্রটা যেন আধুনিক সভ্যতার নামে প্রকৃতিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার এক করুণ দলিল।
যেখানে এক সময় মাঝিরা নদীতে যাত্রী পারাপারের পাশাপাশি মাছ ধরে জীবিকা চালাতেন, সেই জায়গা আজ দখল করেছে শিল্প বর্জ্য, পচা খাবার, হোটেল-দোকানের আবর্জনা ও প্লাস্টিকের স্তূপ। নদী তীরে দাঁড়ালেই নাকে আসে তীব্র গন্ধ, দেখা মেলে না কোনো জলজ প্রাণীর।
স্থানীয় এক প্রবীণ বাসিন্দা জানালেন,
“এ নদীর পানি এক সময় এতটাই স্বচ্ছ ছিল যে ১০ হাত নিচেও মাছ দেখা যেত। এখন তো মাছ দূরের কথা, পানির নিচে শুধু বোতল, প্লাস্টিক আর আবর্জনা।”আরেকজন বললেন,
“আগে নদীতে পোকামাকড় থাকত, এখন বোতল কুড়িয়ে মানুষ কোনোভাবে বাঁচে। এটা নদী নয়, এক গভীর ভাগাড়।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীতে পরিকল্পিতভাবে ময়লা ফেলে তার গভীরতা ও প্রস্থ কমিয়ে তাকে দখলের উপযোগী করা হচ্ছে। আর এই দখলদারিত্বের সবচেয়ে বড় সহায়ক এখন শিল্প বর্জ্য ও প্লাস্টিক। এমনকি নদীর নিচের মাটিতে ১৫ ফুট গভীর পর্যন্ত মিলছে প্লাস্টিকের স্তর, যা ইকোসিস্টেম গঠনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে চিরতরে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
পরিবেশবিদ অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন,
“বুড়িগঙ্গার বিভিন্ন অংশে খনন করে দেখা গেছে, মাছের বদলে প্লাস্টিকই এখন অধিক। শুষ্ক মৌসুমে এখানে কোনো প্রাণ-বান্ধব পরিবেশই থাকে না। এটি একটি মৃত্যুপথযাত্রী নদী।”
২০২৩ সালে বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশন বুড়িগঙ্গার দখল ও দূষণের জন্য ২৮টি প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করে। তবে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ বা শাস্তি আজও দৃশ্যমান নয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইনের পরিবর্তন নয়, দরকার কঠোর প্রয়োগ।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী এম আতিকুর রহমান বলেন,
“নদী রক্ষার জন্য রায় কিংবা নতুন আইন যথেষ্ট নয়। বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ কতটা হয়েছে সেটি পর্যালোচনা জরুরি। আর কমিশনের অগ্রগতি রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রকাশ করা উচিত।”
সাধারণ মানুষসহ পরিবেশ আন্দোলনকারীদের জোর দাবি—নদীতে অবৈধভাবে ময়লা ও রাসায়নিক বর্জ্য ফেলার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নিতে হবে। যারা বুড়িগঙ্গার এই দূরাবস্থার জন্য দায়ী, তাদের চিহ্নিত করে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তার জীবন রক্ষায় কার্যকর কোনো প্রয়াস দেখা যাচ্ছে না।
Leave a Reply