বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে সম্প্রতি পুশ-ইন প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক সপ্তাহে প্রায় প্রতিদিনই ভারতের অভ্যন্তর থেকে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ বাংলাদেশি, রোহিঙ্গা ও UNHCR কার্ডধারী শরণার্থী বাংলাদেশে জোর করে পাঠানো হচ্ছে। কূটনৈতিক আলোচনা চললেও এখনও পর্যন্ত কোনও কার্যকর সমাধান আসেনি। সরকার ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী অবৈধ বাংলাদেশি নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে রাজি থাকলেও, অননুমোদিতভাবে রোহিঙ্গা ও তৃতীয় দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশে পাঠানোর অভিযোগে দারুণ ক্ষুব্ধ। বিষয়টি নিয়ে ডিপ্লোম্যাটিক চ্যানেলে কয়েক দফা প্রতিবাদ জানানো হয়েছে, তবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে এখনও কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। বেশ কয়েকটি সীমান্তবর্তী জেলা এখন পুশ-ইন আতঙ্কের
কেন্দ্রবিন্দুতে:
🔹কুড়িগ্রাম: রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে পুরাতন ২৭ নম্বর সড়ক, নদীপথে বহু
এলাকা কাঁটাতারহীন।
🔸ঝিনাইদহ, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও খাগড়াছড়ি: এই জেলাগুলো থেকেও
প্রতিনিয়ত পুশ-ইনের ঘটনা ঘটছে।
বিশেষ করে কুড়িগ্রাম সীমান্ত এখন মাদক ও মানবপাচার চক্রের জন্য অ্যাকটিভ করিডোর হয়ে উঠেছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, রাতের আঁধারে সশস্ত্র পাহারায় মানুষ ঠেলে পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরে। গত ৭ মে রাতে মিয়ানমার থেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গা দম্পতি মামুদ উল্লাহ ও রোমানা বেগমসহ পাঁচ সদস্যকে পুশ-ইন করে ভারতের বিএসএফ। রোমানা জানান:
“প্রথমে আমাদের গাড়িতে করে নিয়ে যায়, এরপর হাঁটিয়ে সীমান্ত পার করিয়ে দেয়। আমাদের চোখ বাঁধা ছিল। কোন জায়গায় আছি, বুঝতে পারছিলাম না।”
বিজিবি কুড়িগ্রাম-২২ ব্যাটালিয়নের সোনাহাট ক্যাম্প সূত্র জানায়, পরিবারের সদস্যদের পরে উদ্ধার করা হয়, তখনও তারা চরম আতঙ্কে ছিলেন।
সরকারি তথ্যমতে, মে মাসে এ পর্যন্ত মোট ৩৭০ জনকে পুশ-ইন করা হয়েছে। এর মধ্যে:
খাগড়াছড়ি: ৭৩ জন, কুড়িগ্রাম: ৪৪ জন, সিলেট: ২৩ জন, ঝিনাইদহ: ২২ জন, ঠাকুরগাঁও: ১৭ জন, মৌলভীবাজার: ১৫ জন, পঞ্চগড়: ১১ জন, চুয়াডাঙ্গা: ১০ জন
স্থানীয়রা জানান, তারা অনেক সময় ৩০-৪০ জন করে দলবেঁধে অনুপ্রবেশ করতে দেখেছেন, যাদের বেশিরভাগই নিজেদের পরিচয় জানাতে পারেন না। কেউ কেউ ভাষা পর্যন্ত জানেন না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা (অব.) লে. জে. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান:
“বাংলাদেশি হলে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। তবে ভারতের রোহিঙ্গা বা তৃতীয় দেশের নাগরিক হলে তা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী প্রত্যাখ্যান করতে হবে।”
বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন:
“সীমান্তের পরিধি বিশাল। প্রতিটি পয়েন্টে উপস্থিতি রাখা সম্ভব নয়। তাই আনসার বাহিনীর সহায়তা নিচ্ছি। স্থানীয় জনগণকেও সজাগ থাকতে আহ্বান জানানো হয়েছে।”
বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের পুশ-ইন প্রবণতা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আড়ালে থাকা স্পর্শকাতর চাপের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বাংলাদেশে এখন রোহিঙ্গা সংকট যথেষ্ট গভীর এবং অস্থির। তার উপর ভারত থেকে অনিয়ন্ত্রিত প্রবেশ, বিশেষ করে সাংঘর্ষিক এলাকা থেকে আগত শরণার্থীদের ঢল, দেশের নিরাপত্তা ও সামাজিক ভারসাম্য উভয়ই বিঘ্নিত করতে পারে। বাংলাদেশের সীমান্ত এখন শুধু ভৌগোলিক রেখা নয়—এটি হয়ে উঠেছে মানবিকতা, নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক কূটনীতির অগ্নিপরীক্ষার মঞ্চ। এ অবস্থায় শুধু সীমান্ত পাহারা নয়, প্রয়োজন কূটনৈতিক সাহসিকতা ও আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে সরব ভূমিকা।
Leave a Reply