স্বল্পকালীন যুদ্ধবিরতি কাশ্মীরে কিছুটা স্বস্তি আনলেও, যুদ্ধের ছায়া ও অনিশ্চয়তা এখনো তাড়া করে বেড়াচ্ছে উপত্যকার মানুষদের।
শ্রীনগর, ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর — শ্রীনগরের পুরনো ফতে কদল এলাকায় একটি সাধারণ রেশন দোকানে দাঁড়িয়ে ৬২ বছর বয়সী হাজিরা নিজের ওড়না ঠিক করছিলেন। তিনি এসেছিলেন রেশন কার্ডের বায়োমেট্রিক যাচাই করাতে, কিন্তু তাঁর দৃষ্টিতে ছিল যুদ্ধের ভয়।
“আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে,” দোকানদারকে বললেন তিনি। “যেকোনো সময় যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে।”
তাঁর ভয় কেবল ব্যক্তিগত নয় — পুরো উপত্যকাই গত সপ্তাহে এমন আতঙ্কে কেঁপে উঠেছিল। সীমান্তে গোলাবর্ষণ, আকাশে নজরদারি ড্রোন, আকস্মিকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া বিমানবন্দর — এসবই যেন যুদ্ধের পূর্বাভাস হয়ে উঠেছিল। অনেকেই মনে করতে শুরু করেছিলেন ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের দিনগুলো।
তবে শনিবার সন্ধ্যায় হঠাৎই এল কিছুটা স্বস্তির খবর। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিলেন, ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে একটি যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানো গেছে। “আল্লাহর কাছে শুকরিয়া,” বললেন হাজিরা, চোখে ক্ষীণ আশার আলো। “উনি জানেন, আমরা আরেকটা যুদ্ধ সহ্য করতে পারতাম না।”
ট্রাম্পের মধ্যস্থতা: স্বস্তির ইঙ্গিত না সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ?
পরদিন ট্রাম্প জানালেন, তিনি কাশ্মীর ইস্যুর স্থায়ী সমাধান খুঁজতে চাপ সৃষ্টি করবেন। কিন্তু নয়াদিল্লিতে তাঁর বক্তব্যকে ভালোভাবে নেওয়া হয়নি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাফর চৌধুরী বললেন, “ভারতের দৃষ্টিতে কাশ্মীর সমস্যা আসলে সন্ত্রাসবাদজনিত সমস্যা। তাই আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা তারা দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলেই দেখে।”
তিনি আরও বলেন, “তবে ট্রাম্পের পদক্ষেপ কাশ্মীরকে আবারো বিশ্বমানচিত্রে ফিরিয়ে এনেছে — যেখানে এটি আসলেই ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু।”
যুদ্ধবিরতিতে আশার চেয়ে সন্দেহই বেশি
যারা সীমান্তের কাছাকাছি গ্রামে বাস করেন, তারা জানেন যুদ্ধবিরতির মানে সবসময়ই শান্তি নয়। এই এক সপ্তাহেই অসংখ্য গ্রামবাসী গোলাবর্ষণ থেকে বাঁচতে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। শিশু, বৃদ্ধ, নারী — কেউ নিরাপদ নন।
এই যুদ্ধবিরতির কয়েকদিন আগে পাহেলগামে পর্যটকদের ওপর ভয়াবহ এক হামলায় ২৬ জন প্রাণ হারান। এরপরই শুরু হয় ভারতীয় সেনার তীব্র অভিযান: ২৮০০ জনকে গ্রেপ্তার, বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া, ও সাংবাদিকদের হেনস্তা। এক সাংবাদিককে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রমে জড়িত’ অভিযোগে গ্রেপ্তারও করা হয়।
শ্রীনগরের আকাশে এখনো শান্তি নেই। যুদ্ধবিরতির কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাকিস্তান থেকে আসা ‘কামিকাজে’ ড্রোন ঢুকে পড়ে কাশ্মীর আকাশে। সতর্কতা সাইরেন বেজে ওঠে, আকাশে জ্বলজ্বল করে ওঠে রেড ফ্লেয়ার।
“এর আগে কখনও এমন ভয় পাইনি,” বলল ২৪ বছর বয়সী হাসনাইন শব্বির। “যদি এটাই যুদ্ধের প্রস্তুতি হয়, তাহলে সত্যিকারের যুদ্ধ কেমন হয় ভাবতেও ভয় লাগে।”
উরি: উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু
সীমান্তবর্তী উরি শহরে, যেখানে বাদাম ও নাশপাতির গাছে ঘেরা গ্রামে লোকজন শান্তিতে বাস করতেন, সেখানে আজ আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে। ৮ মে সেখানে গোলাবর্ষণে প্রাণ হারান নারগিস বশির। তাঁর গায়ে শরিক শার্পনেলের আঘাত — আর গাড়ির ভেতর তিন সন্তান রক্তাক্ত।
সাবেক সেনা সদস্য মোহাম্মদ নাসির খান বললেন, “আমার বাড়ি একদম ধ্বংস হয়ে গেছে। কীভাবে এখানেই থাকব এখন?”
তাঁর মেয়ে ও নাতনিরা এখনো গ্রামে ফিরতে সাহস পাননি। “তারা বিশ্বাসই করতে পারছে না যে যুদ্ধবিরতি মানে নিরাপত্তা,” বললেন খান।
গ্রামবাসী সুলেমান শেখ বললেন, তাঁর দাদু তাঁকে শিখিয়েছিলেন: যখন বোফর্স কামান গর্জে ওঠে, তখন যুদ্ধ আসন্ন। সেই কামানের গর্জন ৮ মে রাত ২টায় আবার শোনা গেল। তারপর তাঁর বাড়ির উপরই পড়ল গোলা।
“পশুদের রক্ষা করতে চেয়েছিলাম, তাই গ্রাম ছেড়ে যাইনি,” বললেন তিনি। “কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, কীই-বা পেলাম?”
যুদ্ধ নয়, কাশ্মীরিরা চায় স্থায়ী সমাধান
শ্রীনগরের রাস্তাঘাট এখনো ফাঁকা, স্কুলগুলো বন্ধ, আর মানুষের চোখে ক্লান্তির ছাপ। মেডিকেল শিক্ষার্থী মুসকান ওয়ানি বললেন, “শুধু সন্ধ্যা হলেই বোঝা যাবে, এই যুদ্ধবিরতি আদৌ টিকে আছে কি না।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাশ্মীরিদের রাজনৈতিক দাবিদাওয়া যদি বারবার উপেক্ষিত হয়, তাহলে কোনো যুদ্ধবিরতিই স্থায়ী হবে না।
কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক নূর আহমদ বাবা বললেন, “এখানে দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বঞ্চনা আছে। মানুষ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে। বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ তাদের মনে শুধুই অপমানের অনুভব তৈরি করেছে।”
তরুণ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ফুরকান বলেন, “দুই পরমাণু শক্তিধর দেশ নাটক করল, টুইট করল, আর শেষে হাত মিলিয়ে ফেলল। আর আমাদের কি রেখে গেল? শোক, ভাঙা বাড়ি আর না বলা অনেক কথা।”
১০ মে আবারও বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল কাশ্মীর। যুদ্ধবিরতির মাঝেই ফিরে এল আতঙ্ক।
“আমরা জানতাম, এটা বেশিক্ষণ টিকবে না,” বললেন ফুরকান।
২৬ বছর বয়সী মুনিব মেহরাজের কণ্ঠে ছিল হতাশা, “বারবার আমাদেরই বলি হতে হয়। আর কতকাল? আমাদের প্রয়োজন বাস্তবসম্মত, স্থায়ী সমাধান — আর কোনো কল্পনার যুদ্ধবিরতি নয়।”
Leave a Reply