প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডে চলমান মানবিক সংকট ও নিপীড়নের ঘটনায় নতুন করে আরেকটি ‘নাকবা’ ঘটতে পারে — এমন সতর্কবার্তা দিয়েছে জাতিসংঘের একটি বিশেষ কমিটি। গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে লাখ লাখ ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিকে জোর করে সরিয়ে ছয়টি ঘেরাও করা শিবিরে স্থানান্তরের পরিকল্পনার প্রেক্ষিতে এই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
শুক্রবার প্রকাশিত এক বিবৃতিতে কমিটি বলেছে, “নিরাপত্তা অভিযানের ছদ্মবেশে” ইসরায়েল এক ভয়াবহ জাতিগত নির্মূল অভিযান পরিচালনা করছে, যা সাধারণ ফিলিস্তিনি জনগণের উপর অকল্পনীয় যন্ত্রণা চাপিয়ে দিচ্ছে।
“আমরা যা প্রত্যক্ষ করছি, তা হয়তো আরেকটি নাকবার সূচনা,” — বলা হয়েছে আম্মানে অনুষ্ঠিত তথ্য সংগ্রহ মিশনের পর। “ইসরায়েলি সরকারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে জমি দখলের মাধ্যমে উপনিবেশ সম্প্রসারণ।”
শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া ও সেনেগালের রাষ্ট্রদূতদের সমন্বয়ে গঠিত এই কমিটি ইসরায়েলের দখলকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলজুড়ে চলমান ভূমি দখল, বসতি নির্মাণ, বাড়িঘর ধ্বংস এবং জনবিন্যাস পরিবর্তনের অভিযোগ তোলে।
সপ্তাহের শুরুতে ইসরায়েল যে পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে তাতে গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে সরিয়ে দূরবর্তী অঞ্চলের ছয়টি শিবিরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, এসব অঞ্চল কার্যত কারাগারের মতো, যেখানে মৌলিক অধিকার ও মানবিক সহায়তা থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
ফিলিস্তিনিদের জন্য এই পরিকল্পনা ১৯৪৮ সালের ‘নাকবা’ বা বিপর্যয়ের দুঃসহ স্মৃতি ফিরিয়ে আনছে, যখন প্রায় ৭ লাখ ৬০ হাজার ফিলিস্তিনিকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত করা হয়েছিল।
“ভূমি দখল, জোরপূর্বক উচ্ছেদ এবং ধ্বংসকৃত বসতিগুলো একটি সুপরিকল্পিত উপনিবেশবাদী প্রকল্পের অংশ,” জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। “নিরাপত্তা অভিযান আসলে গণউচ্ছেদ ও জনসংখ্যা পুনর্বিন্যাসের মুখোশ মাত্র।”
শুধু উচ্ছেদ নয়, কমিটি আরও তুলে ধরেছে ইসরায়েলি সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ফিলিস্তিনিদের উপর চালানো নিয়মিত নির্যাতনের চিত্র। বন্দিশিবির ও কারাগারগুলোতে যৌন নির্যাতন, শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নকে তারা বলেছে “সংস্থাগত ও পদ্ধতিগত বর্বরতা”।
“এই নির্যাতন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটি একটি সুসংগঠিত কৌশল যার লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে অপমানিত করা, ভীত করা এবং মানসিকভাবে ভেঙে ফেলা,” প্রতিবেদনে বলা হয়।
এমন সময়ে এই প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো যখন গাজায় টানা কয়েক সপ্তাহ ধরে মানবিক সাহায্য সম্পূর্ণভাবে অবরুদ্ধ। খাবার ও ওষুধ বোঝাই ট্রাক সীমান্তে আটকে আছে, অথচ গাজার জনগণ ক্ষুধা, রোগ ও মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে।
“এমন এক বাস্তবতা কল্পনা করা কঠিন, যেখানে একটি সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে একটি জনগোষ্ঠীকে অনাহারে মারতে চায়, অথচ খাদ্যবাহী ট্রাক সীমান্তেই অপেক্ষা করছে,” বলেছে কমিটি। “তবুও, গাজার মানুষদের জন্য এটিই বাস্তবতা।”
এই প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে এবং ইসরায়েলি নেতাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে আইনি পদক্ষেপ জোরদার করতে সহায়ক হতে পারে।
১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিশেষ কমিটি কয়েক দশক ধরে দখলকৃত ফিলিস্তিনি ও আরব ভূখণ্ডে ইসরায়েলের কার্যকলাপ পর্যালোচনা করে আসছে। তবে এই বছরের রিপোর্টটি যেন এক চরম সতর্কবার্তা — ইতিহাসের চাকা আবারও ঘুরে যাচ্ছে।
“নাকবা একসময় ইতিহাসের অধ্যায় ছিল,” কমিটি বলেছে। “কিন্তু গাজায় তা আবারও বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে — আমাদের চোখের সামনেই।”
Leave a Reply