শিল্পখাতে গ্যাসের মূল্য ফের বাড়ানোর সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের রপ্তানিনির্ভর উৎপাদন খাত নতুন করে চাপে পড়েছে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, উৎপাদন ব্যয় ৩ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে, যা রপ্তানি বাজারে দেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতাকে হুমকির মুখে ফেলবে। সেই সঙ্গে নতুন ও পুরাতন গ্যাস সংযোগে পৃথক মূল্যহার প্রবর্তনের কারণে দেশীয় বাজারে সৃষ্টি হতে পারে অস্বচ্ছ, অসম প্রতিযোগিতা—যা শিল্পবান্ধব পরিবেশের পরিপন্থী।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে গ্যাসের মূল্য এক ধাপে ১৫০ থেকে ১৮০ শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়া হয়, যাতে প্রতিশ্রুতি ছিল শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, বাড়তি মূল্য দেওয়ার পরও বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত গ্যাস পাচ্ছে না।
বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, “একদিকে আমাদের বাড়তি গ্যাস বিল দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে যথাযথ সরবরাহ না পাওয়ায় উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে দ্বিমুখী খরচ বাড়ছে।”
চলতি মাসের ১৩ তারিখে সরকার শিল্পখাতে নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম আরও ৩৩ শতাংশ বাড়িয়েছে। পুরনো সংযোগের ক্ষেত্রেও নির্ধারিত লোডের ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহারে বাড়তি মূল্য গুনতে হচ্ছে।
এই অবস্থায় তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি তাদের বিশ্ববাজার থেকে ছিটকে ফেলতে পারে।
ফতুল্লা অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে শামীম এহসান জানান, “নতুন ব্যবসায়ীরা যখন উচ্চমূল্যের গ্যাসে প্রবেশ করবে, তখন তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যাবে। আমরা এরই মধ্যে উৎপাদন খরচ ৩ থেকে ৫ শতাংশ বাড়ার প্রভাব দেখতে পাচ্ছি।”
এছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজারেও অরাজকতা সৃষ্টি হচ্ছে। একই পণ্যের জন্য একেকটি কারখানা একেক মূল্যে গ্যাস পাচ্ছে, যা বাজারে সমতা বজায় রাখা কঠিন করে তুলছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহসভাপতি সালেউদ জামান খান বলেন, “এখন যখন বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম নিম্নমুখী, তখন আমাদের দেশে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি শিল্পবিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।”
জ্বালানি ও অর্থনীতিবিষয়ক সিনিয়র বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের শিল্পখাতের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন দুর্নীতিমুক্ত জ্বালানি নীতি। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)-এর অস্বচ্ছ নীতিমালা ও সিদ্ধান্ত শিল্পের অগ্রগতিতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বলেন, “গ্যাসের দাম বাড়িয়ে আসলে শিল্পে উৎপাদন ব্যয় ও সেবার মূল্য দুটোই বাড়ানো হচ্ছে, যা রপ্তানি সক্ষমতাকে দুর্বল করে তুলছে। বিইআরসির কার্যক্রমে স্বচ্ছতা না এলে এ সংকট কাটবে না।”
তার পরামর্শ, আমদানিনির্ভর জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ গ্যাস উৎপাদনে মনোযোগী হতে হবে। তা না হলে ভর্তুকি বাড়বে, লোডশেডিংও বাড়বে—যার প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতিতে।
Leave a Reply