ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে তার দলের সমর্থকদের এক সমাবেশে বলেছিলেন যে কাশ্মীর শিগগিরই “সন্ত্রাসমুক্ত পর্যটনের স্বর্গ” হয়ে উঠবে, তখন অনেকে তা রাজনৈতিক অঙ্গীকার বলেই ধরেছিলেন। কিন্তু মাত্র সাত মাস পর, পাহেলগামের নির্মম হামলা সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবতাকে গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
২২ এপ্রিল, ভারতশাসিত কাশ্মীরের পর্যটন নগর পাহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৫ জন পর্যটক ও একজন স্থানীয় ঘোড়া চালক নিহত হন। এটি কাশ্মীরে বিগত পঁচিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ পর্যটক-নির্দেশিত হামলা। হামলার পরপরই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে সীমান্ত উত্তেজনা শুরু হয়েছে, পরস্পরের কূটনৈতিক বহিষ্কার ও গোলাগুলিতে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠেছে।
এই ঘটনার পর ভারতের অভ্যন্তরে চলতে থাকা নিরাপত্তা অভিযানও তীব্রতর হয়েছে। কাশ্মীর উপত্যকাজুড়ে শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি ভাঙা, ১,৫০০-এর বেশি ব্যক্তিকে গ্রেফতার এবং সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে নির্বিচার অভিযান — সবই সেই নিরাপত্তানীতির অংশ যা এখন প্রশ্নের মুখে।
দক্ষিণ এশিয়ার জাতীয়তাবাদ ও সংঘাত নিয়ে গবেষণা করা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুমন্ত্র বসু বলেন, “পাহেলগাম হামলা ‘নতুন কাশ্মীর’ ধারণার বেলুনে সূচ ফুটিয়েছে।”
২০১৯ সালে মোদি সরকার ভারতশাসিত কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করে। তখন বলা হয়েছিল, এটি কাশ্মীরকে ভারতের সঙ্গে ভালোভাবে যুক্ত করবে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদকে নিয়ন্ত্রণে আনবে। কিন্তু তা বাস্তবে কতটা কার্যকর হয়েছে, তা পাহেলগামের রক্তাক্ত ঘটনা প্রমাণ করে দিল।
আন্তর্জাতিক সংকট বিশ্লেষক প্রবীণ দন্তি বলেন, “সরকার নিজেদের তৈরি করা শান্তিপূর্ণ কাশ্মীরের ছবি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, যে কারণে তারা পর্যটকদের লক্ষ্যবস্তু হওয়ার সম্ভাবনাকে অবহেলা করেছে।” তিনি আরও বলেন, “তবে যদি অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যায়, তাহলে মাত্র দুজন সশস্ত্র লোকই প্রমাণ করতে পারে যে কাশ্মীরে এখনও স্বাভাবিকতা আসেনি।”
এপ্রিলের গোড়াতেই ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ শ্রীনগরে নিরাপত্তা পর্যালোচনা সভা করলেও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ও স্থানীয় নেতাদের বাদ দেওয়া হয়েছিল। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের পদক্ষেপ মোদি সরকারের কাশ্মীর নীতিতে স্থানীয় বাস্তবতা নয়, বরং কেবলমাত্র পাকিস্তানকেন্দ্রিক কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।
ভারতের দাবি, পাকিস্তান কাশ্মীরের সশস্ত্র বিদ্রোহে অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দিয়ে থাকে, যদিও ইসলামাবাদ বরাবরই তা অস্বীকার করে এবং কেবল ‘নৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থনের’ কথা বলে। কিন্তু এই হামলার পরও যদি ভারত কেবল পাকিস্তানকে দোষ দিয়ে থাকে, তাহলে সমস্যার শেকড়ে পৌঁছানো সম্ভব হবে না বলে মত বিশ্লেষকদের।
কাশ্মীরি রাজনৈতিক ভাষ্যকার শেখ শওকত বলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত কাশ্মীরিদের সঙ্গে সংলাপ শুরু না হয়, ততক্ষণ এই সংঘাতের কোনো টেকসই সমাধান আসবে না।”
পাহেলগাম হামলার জবাবে ভারত ইন্দাস জলচুক্তি থেকে অংশগ্রহণ স্থগিত করেছে — একটি এমন চুক্তি যা তিনটি যুদ্ধ টিকেছে এবং দীর্ঘদিন ধরে দুই দেশের মধ্যে জলবণ্টনের ভারসাম্য রক্ষা করেছে। পাকিস্তান এর জবাবে বলেছে, ভারতের এমন কোনো পদক্ষেপকে ‘যুদ্ধের ঘোষণা’ হিসেবে দেখা হবে। ইসলামাবাদ এমনকি ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তি থেকেও সরে দাঁড়ানোর হুমকি দিয়েছে।
এই জটিল জলোরাজনীতি প্রসঙ্গে অধ্যাপক বসু বলেন, “ভারত জানে পাকিস্তানের কাছে এই পানি জীবনের প্রশ্ন। কাজেই এটি একটি সম্মিলিত শাস্তি দেওয়ার কৌশল — যার ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে।”
হামলার দুই দিন পর বিহারে এক নির্বাচনী সমাবেশে মোদি বলেন, “আমি হামলাকারীদের পৃথিবীর শেষপ্রান্ত থেকেও খুঁজে আনব।” কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, মোদির এমন বক্তব্য কেবল নির্বাচনী শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যেই তৈরি। বিজেপি বরাবরই কাশ্মীরকে একটি আদর্শিক যুদ্ধের ময়দান হিসেবে দেখেছে — যেখানে কঠোর নিরাপত্তানীতিই তাদের দীর্ঘদিনের দর্শন।
এই ঘটনার পর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কাশ্মীরি মুসলিমদের ওপর সহিংসতা, ঘর থেকে বের করে দেওয়া এবং চিকিৎসা সেবা না দেওয়ার মতো খবর এসেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুসলিমবিরোধী ঘৃণার বিস্তারও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
তবে দন্তি মনে করেন, এই সংকট বিজেপির রাজনৈতিক পক্ষে যেতে পারে। তিনি বলেন, “যেখানে বিরোধী দল দুর্বল এবং মূলত জাতীয়তাবাদের সুরে সুর মিলাচ্ছে, সেখানে মোদি সরকার নিজেকে একটি শক্তিশালী অবস্থানে দেখতে পাচ্ছে।”
অন্যদিকে বসু বলেন, “কাশ্মীর মোদি সরকারের জন্য কেবল নিরাপত্তা ইস্যু নয়, এটি একটি আদর্শিক প্রকল্প — যা তারা বদলাবে না।”
Leave a Reply