চুক্তির সম্ভাবনা থাকলেও রাজনৈতিক স্বার্থ আর যুদ্ধনীতি প্রশ্নের মুখে ফেলছে শান্তি প্রক্রিয়াকে
আসন্ন সোমবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প-এর বহুল প্রতীক্ষিত বৈঠক। বৈঠকে গাজায় চলমান ২১ মাসের যুদ্ধের জন্য একটি ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা প্রধান আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যদিও ট্রাম্প আশাবাদী, তবে বিশ্লেষকরা বিষয়টিকে দেখছেন গভীর সংশয়ে—বিশেষ করে অতীতের অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক সংকট এবং মানবিক বিপর্যয়ের প্রেক্ষাপটে।
২০২৫ সালে এটি হবে নেতানিয়াহুর তৃতীয়বারের মতো ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ। তিনি দাবি করেছেন, তারা মিলে ১২ দিনের যুদ্ধের মাধ্যমে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি “ধ্বংস” করেছেন। এখন দৃষ্টি গাজা উপত্যকার দিকে—যেখানে ইসরায়েলি অভিযানে ৫৭,০০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছেন, ইসরায়েল ৬০ দিনের একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। কাতার ও মিশরের মধ্যস্থতায় হামাসও এ প্রস্তাবে “ইতিবাচক সাড়া” দিয়েছে। তবে ইসরায়েল বলেছে, হামাস প্রস্তাবে কিছু পরিবর্তন চেয়েছে যা তাদের কাছে “অগ্রহণযোগ্য”।
প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতির খসড়া অনুযায়ী, ৬০ দিনের জন্য অস্ত্রবিরতি, এবং অক্টোবর ৭-এ আটককৃত ৫৮ ইসরায়েলি বন্দীর ধাপে ধাপে মুক্তি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
তবে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই চুক্তি স্থায়ী শান্তির পথ খুলবে—এমনটা নিশ্চিত নয়।
“এই আলোচনার কাঠামোই সন্দেহ তৈরি করছে,” মন্তব্য করেন ওমর রহমান, মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিশ্লেষক।
তিনি মনে করেন, ট্রাম্প মূলত বন্দী মুক্তির দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন, গাজার মানুষের দুর্ভোগ ও যুদ্ধ থামানোর দিক নয়।
ইতিহাসও বলছে একই কথা: ট্রাম্প অতীতে যুদ্ধ থামানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসেন, কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ইসরায়েল হামলা আবার শুরু করে এবং হাজারো মানুষ নিহত হয়।
মায়রাভ জন্সজাইন বলেন, “আমি সাময়িক যুদ্ধবিরতির বিষয়ে আশাবাদী, তবে এর দীর্ঘস্থায়িতা ও শর্ত নিয়ে বড় প্রশ্ন থেকে যায়।”
গাজার বাসিন্দা ইয়াসের আল-বান্না জানান,
“আধা মানুষ আশাবাদী, অন্যরা মনে করেন নেতানিয়াহু কোনো চুক্তি মানবেন না।”
নেতানিয়াহুর বারবারের ঘোষণা: “হামাসের ওপর পূর্ণ বিজয় ছাড়া যুদ্ধ শেষ হবে না”, যদিও ‘পূর্ণ বিজয়’ শব্দটির কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা তিনি দেননি।
অনেক বিশ্লেষকের মতে, ট্রাম্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে আলোচিত কূটনৈতিক সফলতা দাবি করে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তোলা। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস, বন্দী মুক্তি, এবং ইসরায়েল-আরব সম্পর্ক স্বাভাবিক করাকে নির্বাচনী প্রচারে হাতিয়ার করতে চান তিনি।
খালেদ এলগিন্ডি বলেন, “ট্রাম্প চায় বলতে, সে বন্দী ফিরিয়ে এনেছে, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র পেয়েছে, আর নিজের নাম তুলেছে ইতিহাসে।”
তবে নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক পরিকল্পনা সেই পথের সঙ্গী হবে কি না, তা অনিশ্চিত।
হিউ লাভাট বলেন, “যদি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি হয়, নেতানিয়াহুর জোট ভেঙে পড়বে। আবার তিনি যুদ্ধ চালিয়ে গেলে জোট টিকিয়ে রাখতে পারবেন।”
নেতানিয়াহু বর্তমানে একাধিক দুর্নীতি ও ঘুষের মামলায় অভিযুক্ত। তিনি ক্ষমতার আসনে বসে বিচার ব্যবস্থায় প্রভাব বিস্তার করেছেন, যার কারণে আদালত প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলছে।
ট্রাম্প প্রকাশ্যে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন এবং হুমকি দিয়েছেন যে, যদি ইসরায়েল তা না করে, তবে সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দিতে পারেন।
“এটি ট্রাম্পের কূটনৈতিক কৌশল নয়, বরং চাপ ও ব্ল্যাকমেইলের রাজনীতি,” বলেন এলগিন্ডি।
ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট ইসহাক হার্জগ যদি নেতানিয়াহুকে ক্ষমা দেন, তবে তা হবে নজিরবিহীন। তবে শর্ত হতে পারে—নেতানিয়াহু রাজনীতি ছাড়বেন।
সোমবারের বৈঠক একটি ঐতিহাসিক মোড় কিংবা আরেকটি রাজনৈতিক নাটক—দুটোর একটি হতে পারে। গাজার মানুষ সাময়িক নয়, স্থায়ী সমাধান চায়। কিন্তু নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের কৌশল তাদের এই চাওয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
Leave a Reply