তেহরান যেন আজ এক মৃত নগরী। রাজধানীর আকাশে এখনো ধোঁয়া, বিস্ফোরণের শব্দ আর শূন্যতার প্রতিধ্বনি। ইসরায়েলের আকস্মিক এবং ব্যাপক হামলায় ইরানের বুকে এক ভয়াবহ যুদ্ধ বাস্তবতা নেমে এসেছে — যা লাখো মানুষকে ঘরছাড়া করেছে। আমি নিজেও তাদেরই একজন, পরিবারসহ এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পাড়ি জমিয়েছি।
১৩ জুন, শুক্রবার ভোর ৩টার পর প্রথম বিস্ফোরণগুলো ঘুম ভাঙায় তেহরানের বাসিন্দাদের। ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান, ড্রোন ও দেশীয় এজেন্টদের চালানো ‘স্পাইক’ গাইডেড ক্ষেপণাস্ত্র একযোগে আঘাত হানে রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
ন্যাটাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনা,
আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যাটারি,
বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকদের বাসভবন,
এমনকি বেসামরিক আবাসিক ভবনও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
প্রতিহিংসার শিকার হন ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীরা। সেইসঙ্গে প্রাণ হারান বহু সাধারণ মানুষ। মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তেহরান রূপ নেয় এক আতঙ্ক-আবৃত নগরীতে।
হামলার পরপরই শহরের সব জ্বালানি স্টেশনে দীর্ঘ সারি। ১ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার এই মহানগরীর মানুষ আতঙ্কে পালাতে শুরু করেন। অনেকে শহর ছাড়তে চাইলেও পেরে ওঠেননি—অর্থের অভাব, অসুস্থ স্বজন, বা যানবাহনের সংকটের কারণে।
আমার নিজের অভিজ্ঞতা ছিল এক ভয়াবহ বাস্তবতা। পরিবার, পোষা চারটি বিড়াল আর কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে যখন গাড়িতে উঠি, তখন পশ্চিম তেহরানে একের পর এক বোমা বিস্ফোরণের শব্দ কানে আসছিল।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবনে বোমা ফেলেছে। তৎক্ষণাৎ নতুন করে সতর্কতা জারি হয়—সেই মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিই শহর ছাড়ার।
প্রায় ১২ ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রা শেষে পৌঁছাই ইরানের উত্তরের গিলান প্রদেশে। যারা আশ্রয় খুঁজছেন, তাদের বেশিরভাগই এই অঞ্চলগুলোকেই বেছে নিচ্ছেন। কারণ এখানে ইসরায়েলের টার্গেট কম, আর পরিচিত ভ্রমণস্থান হওয়ায় হোটেল-আবাসনও তুলনামূলক বেশি।
ইরানের উপপুলিশপ্রধান কাসেম রেজাই জানান, মাত্র এক সপ্তাহে মাজানদারানে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ প্রবেশ করেছেন। স্থানীয় মানুষজন নিজেদের ঘর উন্মুক্ত করে দিয়েছেন উদ্বাস্তুদের জন্য।
যুদ্ধের মধ্যেই ইরানজুড়ে ৯৭% ইন্টারনেট বন্ধ। ‘নেটব্লকস’ জানায়, যুদ্ধের প্রথম দিন থেকেই ইন্টারনেট সীমিত করা হয়। প্রো-ইসরায়েলি হ্যাকারদের সাইবার হামলায় দেশের শীর্ষ ব্যাংক ও ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জ ‘নোবিটেক্স’ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সরকার দাবি করছে—এই বিচ্ছিন্নতা ড্রোন ও স্পাই অস্ত্র শনাক্তে জরুরি ছিল, তবে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা জানায়নি পুনরায় সংযোগ চালুর জন্য।
ইরানিরা আজ সর্বাত্মক অনিশ্চয়তা, ক্রোধ ও হতাশার মধ্যে দিন পার করছে। তারা জানে না, কোথায় যাচ্ছে দেশ, কীভাবে শেষ হবে এই যুদ্ধ। একদিকে যুদ্ধের ছায়া, অন্যদিকে বৈশ্বিক একঘরে হয়ে পড়া দেশটির ভবিষ্যৎ যেন কুয়াশাচ্ছন্ন।
Leave a Reply