চলন্ত ট্রেনের দরজার পাশে ঝুলে থাকা এক ব্যক্তির ৩৫ সেকেন্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হতেই নানামুখী আলোচনার জন্ম দেয়। ভিডিওতে দেখা যাওয়া ব্যক্তি, মতিউর রহমান (৪০), ট্রেন থেকে পড়ে গেলেও আশ্চর্যজনকভাবে প্রাণে বেঁচে যান। প্রাথমিকভাবে তাকে ছিনতাইকারী বলে অপবাদ দিলেও, ঘটনার গভীরে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মী পাঠানোর লেনদেন ঘিরে দ্বন্দ্ব ও সহিংসতার অভিযোগ।
নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার পারইল গ্রামের বাসিন্দা মতিউর রহমান পেশায় ছিলেন একজন অটোরিকশাচালক। গত দুই বছর ধরে বিভিন্ন দূতাবাস ও এজেন্সির মাধ্যমে শ্রমিক প্রেরণের সঙ্গে যুক্ত। জানা যায়, সম্প্রতি তিনি আদমদীঘির তালশান গ্রামের হেলালের ছেলে সজীব হোসেনকে সাড়ে ৪ লাখ টাকার বিনিময়ে সৌদি আরবে পাঠান। তবে সেখানে পৌঁছেও বৈধ কাগজপত্র পেতে দেরি হয়। এ নিয়ে শুরু হয় উত্তেজনা।
সজীবের পরিবারের সদস্যরা কয়েকদিন আগে মতিউরের বাড়িতে গিয়ে কাগজপত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে কথা কাটাকাটির সূত্র ধরে বিরোধ সৃষ্টি হয়। ঘটনার ধারাবাহিকতায় রোববার দুপুরে বগুড়া থেকে সান্তাহারগামী কমিউটার ট্রেনে মতিউরকে একা পেয়ে তার ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে সজীবের ছোট ভাই রাকিব ও শ্যালকদের বিরুদ্ধে। পরিবারের দাবি, তারা মতিউরকে ‘মোবাইল চোর’ বলে অপবাদ দিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করে এবং তার সঙ্গে থাকা ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত ৫০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়।
মতিউরের ছেলে আহসান হাবিব বলেন, “আমার বাবা আগেও কয়েকজনকে বিদেশে পাঠিয়েছেন এবং তারা ভালো অবস্থায় আছে। শুধু সজীবের ক্ষেত্রে কিছু বিলম্ব হয়েছে। অথচ তার ভাই ও শ্যালকরা বাবাকে ট্রেন থেকে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করে। বাবা চার-পাঁচ মিনিট ট্রেনের দরজায় ঝুলে থাকার পর নসরতপুর স্টেশনে পৌঁছালে প্ল্যাটফর্মে ধাক্কা লেগে নিচে পড়ে যান। এরপর জনতা বাবাকে ছিনতাইকারী ভেবে মারধর করে।”
পরে আহত অবস্থায় স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। ঘটনা জানাতে গেলে সান্তাহার রেলওয়ে থানায় দায়িত্বরত এক সদস্য পরিবারকে জানান, “আপনার বাবা জীবিত আছেন, মারা গেলে মামলা নেয়া যেত।”
এ ঘটনায় স্থানীয়দের মতেও মতিউরের বিরুদ্ধে এর আগে কোনো প্রতারণার অভিযোগ ওঠেনি। কুসুম্বী গ্রামের হাসান এবং পারইলের আবুল কালাম আজাদ দুজনেই বলেন, “তার মাধ্যমে আমাদের আত্মীয়রা বিদেশে গেছেন, এখনো কোনো সমস্যা হয়নি।”
অন্যদিকে অভিযুক্তদের একজন রাকিব হোসেনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। সজীবের বাবা হেলাল দাবি করেন, “সাড়ে চার লাখ টাকা দিয়েও এখনো আমার ছেলে কাজ পাচ্ছে না। আমি অনেকবার মতিউরের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেছি, সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তবে ট্রেনের ঘটনায় আমার ছেলের কোনো হাত আছে কিনা, তা আমি জানি না। রাকিব কিছু করেনি বলে শুনেছি।”
এ বিষয়ে আদমদীঘি থানার ওসি এসএম মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “ঘটনাস্থল রেলওয়ে থানার আওতায়, তাই আমরা অভিযোগ গ্রহণ করিনি।”
সান্তাহার রেলওয়ে থানার ওসি হাবিবুর রহমান হাবিব জানান, “তারা থানায় এসে ডিউটিরত সেন্ট্রির সঙ্গে কথা বলে চলে গেছেন। আমি তখন উপস্থিত ছিলাম না। তবে এখনো অভিযোগ দিলে বিষয়টি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউ যদি বলে আমরা অভিযোগ নিচ্ছি না, সেটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে, তবে স্থানীয়ভাবে কেউ বিষয়টি জানায়নি।”যদিও মতিউর রহমান জীবিত আছেন এবং চিকিৎসাধীন, প্রশ্ন রয়ে গেছে—একজন রিক্রুটিং এজেন্টকে প্রকাশ্যে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার মতো ঘটনা কীভাবে ঘটল, এবং এতবড় ঘটনা ঘটার পরও কেন স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি এড়িয়ে গেল?
এখন প্রয়োজন একটি নিরপেক্ষ তদন্ত, যাতে প্রবাসে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর শ্রমিক এবং সংশ্লিষ্টদের ভবিষ্যৎ যেন অন্ধকারে না ডুবে যায়। পাশাপাশি, অপপ্রচারে কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যেন গণপিটুনির শিকার না হন—সেটিও নিশ্চিত করা সময়ের দাবি।
Leave a Reply