বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের সমাজে একটি গভীরভাবে প্রোথিত কুসংস্কার এখনও অনেক জায়গায় বিদ্যমান—বোন যদি পৈতৃক সম্পত্তির ন্যায্য হিস্যা বুঝে নেয়, তাহলে সে যেন আর ভাইয়ের বাড়িতে পা রাখার অধিকার রাখে না। এমনকি অনেক ভাই কিংবা তার পরিবার প্রকাশ্যে বলে বসে, “সব কিছু নিয়েই গেছিস, এখন আর আসিস না।”
এই ধরনের আচরণ শুধু আত্মীয়তাবোধের চরম অবক্ষয় নয়, ইসলামিক শরিয়াহ ও মানবিক মূল্যবোধেরও পরিপন্থী।
পিতার সম্পত্তি থেকে বোনেরা তাদের শরিয়তসম্মত অধিকার বুঝে নেওয়ার পরেও তাদের বাবা-মায়ের বাড়ি আসা-যাওয়ার অধিকার অটুট থাকে। তা সে ভাইয়ের দখলে থাকা বাড়িই হোক বা অন্য কেউ ব্যবহার করুক। কারণ, সম্পত্তি একটি আইনগত বিষয় হলেও আত্মীয়তার বন্ধন একটি আবেগ, সংস্কৃতি এবং ঈমানের বিষয়।
ইসলাম স্পষ্টভাবে নারীদের সম্পত্তিতে অংশীদারত্বের বিধান দিয়েছে। কারও প্রতি অনাচার, পক্ষপাত বা বঞ্চনা—তা ছেলে হোক বা মেয়ে—আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে অবস্থান।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,
“পুরুষদের জন্য রয়েছে যা তারা উপার্জন করে, এবং নারীদের জন্য রয়েছে যা তারা উপার্জন করে।” (সূরা আন-নিসা, ৪:৩২)
তবে সমাজে প্রচলিত একটি বিভ্রান্তিকর যুক্তি—”ভাই তো তোদের জন্য অনেক খরচ করেছে, এখন তোদের আর সম্পত্তি চাওয়া উচিত নয়”—একটি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য মানসিকতা। সন্তানকে খরচ করা পিতা-মাতার দায়িত্ব, তার বিনিময়ে তারা মেয়ের ন্যায্য উত্তরাধিকার হরণ করতে পারেন না।
একজন ভাইয়ের উচিত, বোন তার প্রাপ্য বুঝে নেওয়ার পরও আন্তরিকভাবে সম্পর্ক বজায় রাখা। তার সন্তানদের জন্য এই বাড়ি “নানাবাড়ি” হয়ে থাকবে চিরকাল, সেটি রক্ষা করা ভাইয়েরও ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ব।
বরং, একজন প্রকৃত মুসলমানের পরিচয় তখনই প্রকাশ পায়, যখন সে বলে,
“তুমি তোমার প্রাপ্য পেয়েছো—এখন আমরা শুধু ভাইবোন। এই সম্পর্কটা সারাজীবনের। তুমি সবসময় আমাদের বাড়িতে আসবে, এটাই স্বাভাবিক।”
এখনও বহু জায়গায় এই ধারণা চালু—মেয়ে পৈতৃক সম্পত্তি নিলে নাকি পরিবারের অমঙ্গল হয়, কল্যাণ চলে যায়। এ এক ভয়ঙ্কর এবং অবৈজ্ঞানিক কুসংস্কার। ছেলের ভোগে কিছু না হলে, মেয়ের ভোগে সমস্যা কেন হবে? এটা আসলে নারীর হককে মুছে ফেলার এক নির্মম সামাজিক কৌশল।
সম্পত্তি নিয়ে ন্যায্য হিস্যা চাওয়া কোনো অন্যায় নয়, বরং এটি ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনা। আর এই কারণে বোনকে ভাইয়ের বাড়ি থেকে দূরে ঠেলে দেওয়া এক অমানবিক, অশিক্ষিত এবং ধর্মবিরোধী আচরণ।
সম্পর্কে উদারতা, দয়া ও ন্যায়ের আচরণ থাকলেই সমাজ সুন্দর হয়। না হলে, ধর্মের নামে অত্যাচার আর কুসংস্কারই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে এক ভয়ঙ্কর উদাহরণ হয়ে থাকবে।
আল্লাহ আমাদের হক আদায়ের পাশাপাশি হক আদান-প্রদানে উদারতা ও মানবিকতা শেখার তৌফিক দান করুন। আমিন।
Leave a Reply