আরবের এক সময় ছিল যখন কন্যাসন্তানের জন্ম হতাশা ও লজ্জার কারণ হয়ে দাঁড়াত। সামাজিক রীতিতে তার চরম পরিণতি ছিল জীবন্ত পুঁতে ফেলা। সেই অন্ধকার সমাজেই আলোর বার্তা নিয়ে এসেছিলেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। ইসলাম কেবল নারীর জীবন রক্ষা করেনি— বরং নির্ধারণ করেছে তাঁর সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার মধ্য দিয়ে নারীকে যে অবস্থানে তুলে ধরা হয়েছে, তা আজও প্রাসঙ্গিক, যদিও বারবার সেই মর্যাদা নিয়ে বিতর্ক ফিরে আসে।
সম্প্রতি গঠিত নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ঘিরে দেশের বিভিন্ন ইসলামী সংগঠনের প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষাপটে আবারও আলোচনায় এসেছে ইসলামে নারীর অধিকার ও অবস্থান। তবে বিতর্ক নয়— বরং বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন ইসলামি শিক্ষাবিদরা।
সম্মানের জায়গাটি জন্মগত, সৃষ্টিগত, আর আধ্যাত্মিকভাবে নির্ধারিত
শিক্ষাবিদ ও গবেষক ড. নাসিমা হাসান বলেন,
“সূরা বনী ইসরাঈলে আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি বনী আদমকে সম্মানিত করেছি।’ এখানে নারী-পুরুষ ভেদ নেই— উভয়েই আল্লাহর সম্মানিত সৃষ্টি। কোরআনের বহু আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ঈমান, নামাজ, রোজা, দান, চরিত্রের সংরক্ষণ— এসব গুণাবলির ভিত্তিতে নারী-পুরুষ উভয়ের প্রতিদান আল্লাহ সমান রেখেছেন।”
তিনি আরও বলেন, “এই সাম্য কেবল আধ্যাত্মিকতায় নয়— আইন, পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়েছে। মেয়েরা যেমন বিবাহবিচ্ছেদের পর ইদ্দতের সময় ভরণপোষণ পায়, তেমনই সন্তান লালন-পালনের দায়িত্বও পিতার ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে।”
কন্যাসন্তানকে মর্যাদা দেওয়ার দৃষ্টান্ত রেখেছেন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)
ইসলামী চিন্তাবিদ শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন,
“রাসুল (সাঃ) বলেছেন— যার তিনটি কন্যাসন্তান থাকবে এবং সে তাদের যথাযথভাবে লালন-পালন করবে, সেই ব্যক্তি জান্নাতে আমার সঙ্গী হবে। আশ্চর্যজনকভাবে, এমন সুসংবাদ ছেলেসন্তানের জন্য কোথাও নেই। বরং কন্যা সন্তান পালনকে অধিক মর্যাদার কাজে পরিণত করেছেন নবী করিম (সাঃ)।”
তিনি আরও যোগ করেন, “কোরআনে ‘সূরা নিসা’ রয়েছে— নারীদের নিয়ে পূর্ণ একটি সূরা। অথচ পুরুষদের জন্য তেমন সূরা নেই। এতে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিই স্পষ্ট হয়— নারী ও পুরুষ সৃষ্টিগতভাবে সমান মর্যাদাসম্পন্ন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীকে দেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত মর্যাদা ও সুরক্ষা।”
বিতর্কের কেন্দ্রে সম্পত্তির হিসাব— কিন্তু এখানেও রয়েছে সুবিচার
নারী অধিকার নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয় সম্পত্তির বণ্টন নিয়ে— যেখানে ইসলাম নারীকে পুরুষের তুলনায় অর্ধেক হিস্যা দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
শায়খ আহমাদুল্লাহ এই ধারণাকে একপাক্ষিক বলে অভিহিত করেন। তাঁর ভাষায়,
“হিস্যার পার্থক্য ব্যয়ের দায়িত্বের পার্থক্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ছেলেরা যেখানে পরিবার, স্ত্রী, সন্তানদের ব্যয়ের দায়িত্ব বহন করে, সেখানে মেয়েরা তা করে না। বরং নারী যখন স্ত্রী হন, তখন স্বামীর সম্পদ পান, মোহরানা পান। মা হলে সন্তানের সম্পদ পান। এমনকি তালাকের পর ইদ্দতের সময় ভরণপোষণ পান। এই দিকগুলো বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, ইসলাম নারীর প্রতি সুবিচার করেছে— বৈষম্য নয়।”
জ্ঞানচর্চার অভাবেই বাড়ছে ভুল বোঝাবুঝি
ড. নাসিমা হাসান মনে করেন, “সমাজে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জ্ঞানের যে অভাব রয়েছে, সেটাই নারীর মর্যাদা নিয়ে বিভ্রান্তির মূল কারণ। শুধু কোরআন পড়লেই হবে না, তা বুঝতে হবে অর্থসহ, বিশ্লেষণসহ। সেক্ষেত্রে আলেম সমাজকেও নারীর অধিকার বিষয়ে আরও সক্রিয় হয়ে অজ্ঞতার জবাব দিতে হবে।”
শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, “আজকের সমাজে নারী অধিকার নিয়ে কথা বলা ট্রেন্ড হয়ে গেছে। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এমন এক সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন, যেখানে কন্যাসন্তানকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হতো। সেই সমাজে তিনি নারীকে এমন মর্যাদায় উন্নীত করেছেন যে কন্যাসন্তান জন্ম এখন গর্বের বিষয়।”
নারীর সম্মান রক্ষায় নারীদেরই এগিয়ে আসা জরুরি
চিন্তাবিদদের মতে, ইসলামে নারীর সম্মানিত অবস্থানকে দৃশ্যমান ও বাস্তবায়নযোগ্য করতে হলে নারীদেরই সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের বলা, খণ্ডিত জ্ঞান নয়— পূর্ণাঙ্গ বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই ইসলামি মূল্যবোধে নারীর প্রকৃত মর্যাদা প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
Leave a Reply