রাজধানী ঢাকায় গ্যাস সংকট দীর্ঘমেয়াদী রূপ নিয়েছে। প্রতিদিনের রান্নাবান্না থেকে শুরু করে পরিবহন ও শিল্প উৎপাদন—সব ক্ষেত্রেই ঘাটতির ছাপ স্পষ্ট। একদিকে গৃহস্থালি রান্নার চুলা প্রায় অচল, অন্যদিকে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে সিএনজির জন্য হাহাকার।
এর মধ্যে বিতরণ সংস্থা তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির এক কর্মকর্তার পরামর্শ, যারা দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস পাচ্ছেন না, তারা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে সিলিন্ডার ব্যবহারে মনোযোগী হোন—এ মন্তব্যে গ্রাহক অসন্তোষ আরও তীব্র হয়েছে।
দিলু রোড থেকে মিরপুর—চারদিকে একই সুর, মগবাজারের দিলু রোড, কলাবাগান, সেন্ট্রাল রোড, কাঁঠাল বাগান কিংবা মিরপুর—প্রায় প্রতিটি এলাকা থেকেই মিলছে এক অভিযোগ: চুলায় গ্যাস নেই, অথচ বিল ঠিকই দিতে হচ্ছে।
এক বাসিন্দা জানান, “রান্নার জন্য প্রতিদিন গ্যাস আসবে কি না, সেটাই এখন চিন্তার বিষয়। গভীর রাতে সামান্য সময়ের জন্য চাপ আসে, সেটুকুতে খাবার তৈরি সম্ভব নয়।”
সিলিন্ডার ও বিদ্যুতে নির্ভরতা বাড়লেও খরচ বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে বাধ্য হয়ে অনেকে এখন রান্নার জন্য নির্ভর করছেন এলপিজি সিলিন্ডার কিংবা বৈদ্যুতিক হটপ্লেটের ওপর। তবে এর ফলে বাড়ছে ব্যয়, চাপ পড়ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের সংসারে।
সড়কে চলাচলকারী যানবাহনের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস মিলছে না সময়মতো। স্টেশনগুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও অনেক চালক গ্যাস না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
এক সিএনজি চালক বলেন, “সকাল থেকে সন্ধ্যা—তিন ঘণ্টা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। শেষে জানানো হয় গ্যাস শেষ।”
তিতাস গ্যাসের অপারেশন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক প্রকৌশলী কাজী মোহাম্মদ সাইদুল হাসান বলেন, “প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ ঘাটতি রয়েছে। যে সব এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে গ্যাস যাচ্ছে না, সেসব বাসায় সংযোগ বন্ধ করাই যুক্তিযুক্ত। সেই টাকা দিয়ে সিলিন্ডার কেনা-ব্যবহার করা যেতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “তিতাসের অনেক কর্মকর্তা নিজেরাও বাসায় সিলিন্ডার ব্যবহার করেন। এখন পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিকল্প পথ বেছে নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্যাসের সংকট ‘মানসিক নয়, বাস্তব’—প্রয়োজন জরুরি অনুসন্ধান ও উত্তোলন
জ্বালানি ও ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের ভূগর্ভে যথেষ্ট গ্যাস রয়েছে। কিন্তু নতুন গ্যাস ক্ষেত্রের অনুসন্ধান ও উত্তোলনে সরকারের উদ্যোগ কম হওয়ায় সংকট দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, “বাংলাদেশ বদ্বীপ অঞ্চল। এখানে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করা সম্ভব। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে উত্তোলন বাড়াতে না পারলে সংকট আরও বাড়বে।”
শিল্প খাতেও ধস, অর্থনৈতিক চাপে উৎপাদন ব্যাহত
গ্যাস সংকটের তীব্রতা শুধু গৃহস্থালিতে সীমাবদ্ধ নয়। বড় বড় শিল্প কারখানার চুলাও এখন অচল। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, কর্মসংস্থান ও রপ্তানিতেও দেখা দিচ্ছে শঙ্কা।
সরকারি সংস্থাগুলোর সীমাবদ্ধতা থাকতেই পারে, তবে শহরবাসীর নিত্য প্রয়োজন মেটাতে একটি টেকসই পরিকল্পনা এখন সময়ের দাবি। তিতাসের পরামর্শের চেয়ে বাস্তবসম্মত ও সমন্বিত পদক্ষেপই পারে এই সংকটের সুরাহা করতে।
Leave a Reply