গাজা উপত্যকায় জনসংখ্যা পুনর্গঠনের লক্ষ্যে ইসরায়েলি সরকারের ঘোষিত এক নতুন উদ্যোগকে কেন্দ্র করে তীব্র উদ্বেগ তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এই পরিকল্পনা কার্যকর হলে তা জাতিগত নিধনের রূপ নিতে পারে এবং ভবিষ্যতে আরও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি এই পরিকল্পনার ঘোষণা দেন। তিনি দাবি করেন, এর মূল লক্ষ্য হামাসকে ধ্বংস করা এবং ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে অপহৃত প্রায় দুই ডজন ইসরায়েলি বন্দিকে মুক্ত করা। তবে বিশ্লেষকদের মতে, বাস্তব চিত্র আরও গভীর ও উদ্বেগজনক।
আল জাজিরা ও অন্যান্য গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, এই পরিকল্পনার আওতায় গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে লক্ষাধিক ফিলিস্তিনিকে জোরপূর্বক সরিয়ে দক্ষিণাঞ্চলে ছয়টি নির্ধারিত ক্যাম্পে স্থানান্তর করা হবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এই ক্যাম্পগুলোকে “ঘনীভূতকরণ কেন্দ্র” বা “Concentration Hubs” হিসেবে অভিহিত করেছে।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ বলছে, এসব ক্যাম্পে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে এবং তা বিতরণ করবে কিছু সাহায্য সংস্থা ও বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থা। কিন্তু বাস্তবে, প্রতিটি পরিবারকে সপ্তাহে একবার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে খাবারের প্যাকেট সংগ্রহ করতে হবে—যা অনেকের মতে, ক্ষুধার ভয় দেখিয়ে মানুষকে জোর করে স্থানান্তরিত করার একটি কৌশল।
“এটি মানবিক সহায়তা নয়—এটি ক্ষুধার হুমকি দিয়ে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির একটি রূপ,” বলেন নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের সেক্রেটারি জেনারেল ইয়ান এগেল্যান্ড। “এই ক্যাম্পগুলো কোনো নিরাপদ এলাকা নয়, এগুলো হলো নিয়ন্ত্রণের জন্য তৈরি ঘেরাওকৃত জোন।”
সমালোচকদের মতে, এই পরিকল্পনা গাজায় ইসরায়েলের অভিযানকে এক নতুন ও বিপজ্জনক মোড়ে নিয়ে যাচ্ছে। উত্তরের জনগণকে উচ্ছেদ করে, তাদের সীমিত সহায়তা-নির্ভর ক্যাম্পে আটকে রাখার মাধ্যমে, দীর্ঘমেয়াদে গাজার জনবিন্যাস পরিবর্তনের একটি চেষ্টা শুরু হয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হলে তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের একাধিক ধারা লঙ্ঘন করতে পারে—বিশেষ করে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি এবং সম্মিলিত শাস্তি সংক্রান্ত বিধান।
“এটি জাতিগত নিধনের একটি পাঠ্যবইসুলভ উদাহরণ,” বলেন আন্তর্জাতিক সংকট গবেষণা সংস্থার এক জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক (নিরাপত্তাজনিত কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)। “এটি কেবল একটি সামরিক অভিযান নয়—এটি একটি রাজনৈতিক কৌশল, যার প্রভাব হতে পারে ফিলিস্তিনিদের জন্য দীর্ঘস্থায়ী ও ধ্বংসাত্মক।”
আন্তর্জাতিক নীরবতা ও বাড়তে থাকা উদ্বেগ মানবাধিকার সংস্থা ও সাহায্য সংস্থাগুলোর বারবার হুঁশিয়ারির পরও এখনো পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া অনেকটাই নীরব। সমালোচকরা বলছেন, বিশেষ করে পশ্চিমা শক্তিগুলো—যারা ইসরায়েলের প্রধান মিত্র—তারা কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না, যার ফলে মানবিক বিপর্যয় আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
এদিকে গাজার ভেতরে পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। ইতোমধ্যে ১০ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো উপচে পড়ছে, খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট চলছে, আর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, আগামী কয়েক সপ্তাহ হবে চূড়ান্তভাবে নির্ধারক—শুধু গাজার ভবিষ্যতের জন্য নয়, বরং বৈশ্বিক মানবাধিকার রক্ষার নীতিগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতার জন্যও।
Leave a Reply