হজ—এটি কেবল একটি ধর্মীয় রীতি নয়, বরং এটি এক গভীর প্রেমের পরিক্রমা। এমন এক প্রেম, যা দুনিয়ার কোনো মোহ কিংবা পার্থিব লাভের নয়। এই সফরের মূল চালিকাশক্তি হলো—محبة الله, আল্লাহর প্রতি নিখাদ ভালোবাসা। সেই ভালোবাসা যার ডাকে সাড়া দিয়ে মুমিন বান্দা অগ্রসর হয় আল্লাহর পবিত্র ঘর, বাইতুল্লাহর দিকে। যেখানে পৌঁছাতে হয় ত্যাগ, তিতিক্ষা আর অন্তরের কান্না দিয়ে।
কুরআনের ভাষায় এই প্রেম:
والذين آمنوا أشد حباً لله
“আর যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহকে সর্বাধিক ভালোবাসে।”
(সুরা আল-বাকারা: ১৬৫)
এই ভালোবাসাই এক মুমিনকে ঘর-পরিবার, সম্পদ, আর দুনিয়াবি পরিচয় সবকিছু ছেড়ে কেবল একটি শব্দের দিকে টেনে নেয়—
“لَبَّيْكَ، اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ”
আমি হাজির, হে আল্লাহ! আমি হাজির…
হজ: আহ্বানের জবাব, প্রেমিকের সাড়া
হজ কোনো হঠাৎ পরিকল্পিত সফর নয়। এটি শুরু হয় সেই দিনের ঘোষণার মাধ্যমে, যেদিন হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর আদেশে পাহাড় চূড়া থেকে ডাক দিয়েছিলেন:
وأذِّن في الناس بالحج
“মানুষের মাঝে হজের আহ্বান জানাও।”
(সুরা হজ: ২৭)
তিনি জানতেন না কে আসবে, কে সাড়া দেবে। কিন্তু আল্লাহ জানতেন—যার হৃদয়ে প্রেম আছে, সেই-ই সাড়া দেবে। তাই যুগের পর যুগ, হাজারো পথিক কা‘বার দিকে পা বাড়ায়—পায়ে হেঁটে, উটের পিঠে, কিংবা বিমানে। উদ্দেশ্য একটাই—প্রিয় প্রভুর ঘরে পৌঁছানো।
হজের প্রতিটি রোকন প্রেমে মিশে আছে:
১. ইহরাম: পরিচয় বিসর্জনের পোশাক
ইহরাম হলো আত্মবিস্মরণের প্রথম ধাপ। সব আরাম, অভিজাততা, সামাজিক পরিচয় খুলে রেখে মানুষ দাঁড়ায় দাসত্বের পোশাকে। যেন বলছে—“আজ আমি কেবল তোমার প্রেমে ডুবে থাকা এক বান্দা। আমার নেই কোনো গৌরব, নেই অহংকার।”
২. লাব্বাইক: আত্মসমর্পণের চিৎকার
লাব্বাইক হলো আত্মার কান্না। এক প্রেমিকের আকুতি—“হে প্রভু! আমি এসেছি, তোমার ডাকে সাড়া দিয়ে!” এই শব্দে লুকিয়ে আছে চোখের পানি, ভালোবাসা, আত্মসমর্পণ এবং এক অনাবিল নিবেদন।
৩. তাওয়াফ: হৃদয়ের আবর্তন
প্রেমিক তার প্রিয়জনকে ঘিরে ঘোরে। কা‘বার চারপাশে তাওয়াফ করা সেই হৃদয়ের আক্ষরিক প্রকাশ—যেখানে আত্মা আবর্তিত হয় প্রেমে, ভক্তিতে ও আরাধনায়।
৪. সাফা-মারওয়া: আস্থার দৌড়
হজরত হাজেরা (আ.)’র ছুটে চলা কেবল পানির খোঁজ ছিল না—তা ছিল বিশ্বাস, দায়িত্ব ও আত্মসমর্পণের প্রতীক। আজও হজযাত্রীরা সেই প্রেমভরা দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি করে—একটি মায়ের ঈমানের পথে নিজের হৃদয় মিলিয়ে নেয়।
৫. আরাফা: আত্মার মিলনমঞ্চ
আরাফার দিন হজের কেন্দ্রবিন্দু। এই দিন বান্দা দাঁড়ায় প্রভুর সামনে—কাঁদে, মিনতি করে, ক্ষমা চায়। যেন বলছে—“হে আল্লাহ! আমাকে পাপমুক্ত করো, আমাকে তোমার বান্দা করে নাও।”
الحج عرفة
“হজ মানে আরাফা।”
(তিরমিজি: ৮৮৯)
হাদিসের আলোকে: কারা আল্লাহর মেহমান?
الحجّاجُ والعُمّارُ وفدُ اللهِ، إنْ دعَوْهُ أجابَهُم، وإنِ استغفَروهُ غفَرَ لهُم
“হজ ও উমরাকারীরা আল্লাহর মেহমান। তারা ডাকে—আল্লাহ উত্তর দেন। তারা ক্ষমা চায়—আল্লাহ ক্ষমা করে দেন।”
(সুনান ইবনে মাজাহ: ২৮৯২)
এই মর্যাদা কেবল আনুষ্ঠানিকতাজনিত নয়; বরং এটি অর্জিত হয় নিখাদ ভালোবাসা, নিঃস্ব আত্মসমর্পণ, আর অন্তরের আনুগত্য দিয়ে।
হজ কেবল সফর নয়, এটি প্রেমের আহ্বান
হজ একটি ইবাদত, একটি আত্মশুদ্ধির সফর, কিন্তু তার চেয়েও বড়—এটি আল্লাহর প্রতি নিখাদ প্রেমের এক সাড়া। যার হৃদয়ে সেই প্রেম নেই, তার কাছে হজ হয়তো কেবলই ভ্রমণ। আর যার হৃদয় ভরা আল্লাহর ভালোবাসায়, তার কাছে হজ এক অনন্ত সম্মিলন।
اللهم اجعلنا من المحبين لك، والمقبولين عندك، ومن وفدك المبارك، واجعل حجنا حجًا مبرورًا، وسعينا مشكورًا، وذنبنا مغفورًا. آمين.
হে আল্লাহ! আমাদের তাদের অন্তর্ভুক্ত করুন, যারা তোমাকে ভালোবাসে, তোমার মেহমান হয়ে কবুল হয়, যাদের হজ মাকবুল হয়, যাদের চেষ্টা তুমি কবুল করো, আর যাদের পাপ তুমি ক্ষমা করে দাও। আমিন।
Leave a Reply