বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে প্রায়ই সরব দেখা যায় ভারতকে। তবে নিজ দেশেই সংখ্যালঘুরা কতটা নিরাপদ, তা নিয়ে উঠেছে গুরুতর প্রশ্ন। সাম্প্রতিক এক ঘটনার প্রেক্ষিতে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের বিপুল ওয়াকফ সম্পত্তি দখলের অভিযোগ।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনী শহরে শতাব্দী প্রাচীন মসজিদসহ প্রায় ২৫০টি অবকাঠামো ধ্বংস করে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। এসব অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় বুলডোজারের মাধ্যমে। উচ্ছেদ হওয়া ২.১ হেক্টর (৫.২৭ একর) জমি মধ্যপ্রদেশ ওয়াকফ বোর্ডের মালিকানাধীন ছিল বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে মুসলিমরা যে সম্পত্তি দান করে থাকেন, তাকে ওয়াকফ বলা হয়। এগুলোর হস্তান্তর, বিক্রয় কিংবা ব্যক্তিগত ব্যবহার আইনত নিষিদ্ধ। অথচ উজ্জয়িনীর ওই জমি ‘মহাকাল করিডোর’ নামে এক বিলিয়ন ডলারের একটি সরকারি প্রকল্পের অংশ হিসেবে অধিগ্রহণ করা হয়েছে।
আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে প্রায় ৮.৭২ লক্ষ ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে, যার আনুমানিক মূল্য ১৪.২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এসব সম্পত্তির তত্ত্বাবধান করে রাজ্যভিত্তিক ওয়াকফ বোর্ডগুলো। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ভারতের সেনাবাহিনী ও রেলওয়ের পরে ওয়াকফ বোর্ডই দেশের তৃতীয় বৃহত্তম জমির মালিক।
উজ্জয়িনীর ঘটনায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছেন মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা। তাঁরা বলছেন, বহু বছর ধরে ওয়াকফ সম্পত্তির অব্যবস্থাপনা ও দখলদারিত্ব চলেছে এবং প্রস্তাবিত ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল ২০২৪ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে।
নতুন এই বিলের আওতায় সরকার ওয়াকফ সম্পত্তির ওপর আরও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারবে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রস্তাবে উল্লেখ আছে, অমুসলিমদেরও বোর্ডে নিয়োগ এবং ওয়াকফ সম্পত্তির বাধ্যতামূলক নিবন্ধন জেলা প্রশাসনের সাথে করতে হবে।
এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে, ১৯৮৫ সালের সরকারি গেজেটে উজ্জয়িনীর উচ্ছেদ হওয়া জমি মুসলিম কবরস্থান হিসেবে চিহ্নিত ছিল। এমনকি স্থানীয় রাজস্ব বিভাগের একজন কর্মকর্তা জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতা করেছিলেন। তবুও জেলা প্রশাসন জানায়, “সামাজিক উদ্দেশ্যে জমি অধিগ্রহণে অনুমতির প্রয়োজন নেই।”
বিশ্লেষকরা বলেন এই অধিগ্রহণকে সরাসরি ওয়াকফ আইনের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছেন। যদিও সরকার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৩৩০ মিলিয়ন রুপি দিয়েছে, অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন – কেন ওয়াকফ বোর্ড সেই ক্ষতিপূরণের দাবি তোলে না?
এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে মধ্যপ্রদেশ ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বিজেপি নেতা সানাওয়ার প্যাটেল বলেন, “দল যা আদেশ দেবে, আমি তাই করব।” তিনি জানান, তারা ক্ষতিপূরণ বিতরণ না করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন, তবে কেন আইনি পথে যাননি, তা স্পষ্ট করেননি।
মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টে দায়েরকৃত এক জনস্বার্থ মামলায় বলা হয়েছে, উজ্জয়িনীতে ওয়াকফের অন্তর্ভুক্ত ১,০১৪টি সম্পত্তির মধ্যে অনেকগুলোই ব্যক্তিমালিকানাধীন বা সরকারি হিসেবে তালিকাভুক্ত। এমনকি সফটওয়্যারের সীমাবদ্ধতার কারণে ওয়াকফ জমি প্রায়শই ‘সরকারি’ হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছে।
আইনজীবী ও সমাজকর্মীরা মনে করছেন, প্রস্তাবিত নতুন সংশোধনী বিল সরকারের ইচ্ছাকৃত দখল ও অনিয়মকে আরও বৈধতা দেবে। ভোপালের ঐতিহাসিক মতি মসজিদের মতো বহু জমি ইতোমধ্যে সরকারি সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে।
বিরোধী দল আম আদমি পার্টির সংসদ সদস্য সঞ্জয় সিং এই বিলের বিরোধিতা করে বলেন, “এটি মসজিদ এবং দরগাহর জমি দখলের শুরু। ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।”
সরকার পক্ষ যদিও বলছে, এই সংশোধনীর মাধ্যমে ওয়াকফ ব্যবস্থায় দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান হবে, তবে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে।
Leave a Reply