গাজা থেকে জীবন বাঁচাতে বের হলেও কোথায় গিয়ে পৌঁছাবেন তা জানতেন না লোয়াই আবু সাইফসহ ১৫৩ ফিলিস্তিনি। ২৪ ঘণ্টার দুর্বিষহ যাত্রায় ইসরায়েলের সমন্বয়, ট্রানজিট জটিলতা, এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবেশ নিয়ে উত্তেজনার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে বিতর্কিত এক ইভাকুয়েশন প্রক্রিয়ার ভয়াবহ বাস্তবতা।গাজা উপত্যকা থেকে বের হওয়ার সময় তাদের কাছে ছিল না কোনো নিশ্চিত তথ্য—গন্তব্য কোথায়, কীভাবে পৌঁছাবেন, বা আদৌ নিরাপদে যেতে পারবেন কি না। এমন অনিশ্চয়তা নিয়েই গাজা থেকে বের হয়েছিলেন লোয়াই আবু সাইফ তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে। পরে জানা যায়, তারা ১৫৩ ফিলিস্তিনির একটি দলে ছিলেন, যাদের দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছানো নিয়ে চলছে ব্যাপক বিতর্ক।
সংবাদ মাধ্যম আল জাজিরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে উঠে আসে এই নির্মম বর্ণনা লোয়াই আবু সাইফ বলেন, গাজা থেকে বের হওয়া ছিল “দুর্ভোগে ভরা এক যাত্রা”—একটি “trip of suffering।” তিনি বলেন, “আমরা কখনোই ভাবিনি যে কারও পক্ষে আমাদের এভাবে ইভাকুয়েট করা সম্ভব হবে।” গাজা থেকে বেরিয়ে তিনি এখন নিরাপদ বোধ করছেন—যা ফিলিস্তিনিদের জন্য বিশেষ করে গাজাবাসীদের কাছে অনেক বড় বিষয়।
এখন ধীরে ধীরে সামনে আসছে বিতর্কিত এক ট্রানজিট ব্যবস্থার তথ্য, যেটির সঙ্গে জড়িত একটি এনজিও এবং অভিযোগ রয়েছে যে, ইসরায়েল এই প্রক্রিয়াকে সহায়তা করে ফিলিস্তিনিদের গাজা ছাড়তে উৎসাহিত করছে। আবু সাইফের বিবরণ অনুযায়ী, ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সরাসরি সমন্বয় ছাড়া এই যাত্রা সম্ভবই ছিল না।
এই দলের চার্টার্ড বিমানে যাত্রা শুরু হয় ইসরায়েলের রামোন বিমানবন্দর থেকে। ট্রানজিট হয় কেনিয়ার নাইরোবিতে, এবং সেখান থেকে বৃহস্পতিবার সকালে তারা পৌঁছান দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে। তবে সেখানে নামতে প্রথমে বাধা দেওয়া হয়, কারণ তাদের কোনো ডকুমেন্টে ইসরায়েলের ডিপার্চার স্ট্যাম্প ছিল না।
মোট যাত্রা সময় লেগেছে ২৪ ঘণ্টারও বেশি, তাও আবার বিমানের পরিবর্তনসহ। আবু সাইফ জানান, তারা জানতেনই না কোথায় যাচ্ছেন; নাইরোবিতে প্লেন বদলের সময়ই প্রথম জানতে পারেন যে গন্তব্য জোহানেসবার্গ।
জর্ডানের আম্মান থেকে আল জাজিরার নুর ওদেহ জানান, ইসরায়েলের ‘সমন্বয়’ ছাড়া এসব যাত্রী কোনোভাবেই গাজা থেকে বের হতে পারতেন না। তিনি বলেন, “গাজার হলুদ লাইন পার হতে চাইলে মুহূর্তেই গুলি করা হয়। এই মানুষদের সেই লাইন পার করে ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চল ধরে রামোন বিমানবন্দরে নেওয়া হয়েছে।”
আবু সাইফ জানান, তার স্ত্রী একটি এনজিও আল-মাজদ ইউরোপ-এ পরিবারের নাম নিবন্ধন করেন। সংস্থাটি জার্মানিতে অবস্থিত এবং জেরুজালেমে তাদের অফিস রয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার বিজ্ঞাপন থেকে তারা নিবন্ধনের বিষয়ে জানেন।
নির্বাচনের শর্ত হিসেবে ছিল—
সন্তানের উপস্থিতি (অগ্রাধিকার),
বৈধ ফিলিস্তিনি ট্রাভেল ডকুমেন্ট,
এবং ইসরায়েলের সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স।
ব্যয়ের দিক থেকে প্রতি ব্যক্তির জন্য ১,৪০০–২,০০০ ডলার পর্যন্ত নেওয়া হয়। শিশু–শিশুর ক্ষেত্রেও একই পরিমাণ অর্থ দিতে হয়েছে।
গাজা থেকে রফাহ হয়ে তাদের বাসে করে কেরেম শালোম সীমান্তে নেওয়া হয়, যেখানে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাদের চেক করে। পরে রামোন বিমানবন্দরে পাঠানো হয়। এখানেই তাদের ভ্রমণ ডকুমেন্টে কোনো স্ট্যাম্প দেওয়া হয়নি—যা পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবেশের সময় বড় সমস্যায় পরিণত হয়।
আবু সাইফ বলেন, আল-মাজদ সংস্থা জানিয়েছে তারা এক–দুই সপ্তাহ সহায়তা করতে পারবে, তারপর নিজেদের পথ নিজেদেরই খুঁজে নিতে হবে। অনেক যাত্রীর আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল—
অস্ট্রেলিয়া,
ইন্দোনেশিয়া,
মালয়েশিয়া—
এর মত দেশে যাওয়ার।
তিনি জানান, যাত্রীদের প্রায় ৩০ শতাংশ দক্ষিণ আফ্রিকায় নামার পরই অন্য গন্তব্যে রওনা দেন। বাকিরা চিকিৎসা বা সাময়িক আশ্রয়ের জন্য সেখানে থাকতে পারেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছে, মোট ১৫৩ জনের মধ্যে ১৩০ জন দেশটিতে প্রবেশ করেছে, এবং ২৩ জন সরাসরি অন্য দেশে চলে গেছে।
আবু সাইফ বলেন, “মানুষ হিসেব করেছে—গাজার তুলনায় যেকোনো দেশের জীবনযাত্রার ব্যয় কম।”
এই যাত্রা শুধু গাজাবাসীদের দুর্ভোগই নয়, বরং একটি বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে—গাজা থেকে মানুষের এই ‘নীরব স্থানান্তর’ আসলে কী উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে?
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.