শনিবার গাজা ভূখণ্ডে ইসরায়েলের বিমান ও ড্রোন হামলায় অন্তত ১৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে তিনজন শিশু রয়েছে। কয়েক মাস ধরে চলা অবরোধের মধ্যেই এই হামলা সংঘটিত হয়, যা সংকটাপন্ন এই উপকূলীয় এলাকার মানবিক বিপর্যয়কে আরও গভীরতর করেছে।
প্যালেস্টিনীয় বার্তা সংস্থা ওয়াফা জানায়, গাজা সিটির সাবরা এলাকায় একটি তাঁবু লক্ষ্য করে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান হামলা চালায়, যেখানে তালিব পরিবারের পাঁচ সদস্য নিহত হন। নিহতদের মধ্যে তিন শিশু, তাদের মা এবং মায়ের স্বামী ছিলেন।
“তারা ঘুমিয়ে ছিল, তখনই হামলা হয়। কোনো সতর্কতা ছিল না, কোনো কারণও ছিল না। তারা ছিল নিরীহ,” সংবাদমাধ্যম এএফপি-কে বলেন নিহত শিশুদের নানা ওমর আবু আল-কাস।
এছাড়া, গাজা সিটির তুফাহ এলাকায় ড্রোন হামলায় আরও ছয়জন এবং শেখ রাদওয়ান এলাকায় জাকুত পরিবারের একটি অ্যাপার্টমেন্টে হামলায় আরও একজন নিহত হন।
গাজা উপত্যকার দক্ষিণে, রাফাহ উপকূলে ইসরায়েলি নৌবাহিনী “মারাত্মক গুলি বর্ষণ” চালায় বলে জানায় ওয়াফা, যেখানে মোহাম্মদ সাঈদ আল-বারদাওয়িল নামের একজন ব্যক্তি নিহত হন। রাফাহর আল-মাওয়াসি মানবিক এলাকায় হামলায় আরও দুজন আহত হন।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, গত ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ২৩ জন নিহত ও ১২৪ জন আহত হয়েছেন।
এই সহিংসতা এমন এক সময় ঘটছে, যখন মার্চের শুরু থেকে ইসরায়েল সব ধরনের পণ্য, খাদ্য ও ওষুধ প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, যার ফলে গাজার জীবনযাত্রা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে।
গাজার কেন্দ্রীয় শহর দেইর আল-বালাহ থেকে আল জাজিরার প্রতিবেদক হিন্দ খুদারি জানান, “খাবার প্রায় নেই বললেই চলে। বেকারিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে, বিতরণ কেন্দ্র নেই, মাত্র কিছু হট-মিল কিচেন টিকে আছে।”
তিনি জানান, আগে যেখানে এক কিচেন ১০০ জনকে খাওয়াতো, এখন সেটা ২০০০ জনকে দিতে হচ্ছে। “আমরা প্রতিদিন আরও শিশুদের মরতে দেখছি, শুধুমাত্র অপুষ্টি নয়, চিকিৎসা, জ্বালানি, রান্নার গ্যাস – সব কিছুরই ঘাটতি,” বলেন তিনি।
এমন পরিস্থিতিতে ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রাল কিচেন, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দাতব্য সংস্থা, জানিয়েছে যে তারা পর্যাপ্ত মজুত না থাকায় খাদ্য পরিবেশন বন্ধ করে দিয়েছে।
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা বিভাগ (UNOCHA) এক বিবৃতিতে বলেছে:
“শিশুরা অনাহারে মারা যাচ্ছে। কমিউনিটি কিচেনগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। পরিষ্কার পানিও ফুরিয়ে আসছে।”
জটিল রোগে আক্রান্তদের জীবন হুমকির মুখে চিকিৎসা সামগ্রীর প্রবেশ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গাজায় ক্যানসার, ডায়াবেটিস, মল্টিপল স্ক্লেরোসিস, হেপাটাইটিস ও অটোইমিউন রোগে আক্রান্তরা ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে আছেন।
আল জাজিরার হানি মাহমুদ গাজা সিটি থেকে বলেন, “এখানকার ডাক্তাররা বলছেন, এই ট্র্যাজেডি কেবল ঘটছে না – এটি প্রতিরোধযোগ্য ছিল।”
একজন বাবা জানান, তার ১০ বছরের ডায়াবেটিস আক্রান্ত সন্তানের জন্য ইনসুলিন খুঁজে পেতে তাকে পুরো দিন কাটাতে হয়।
“আমি ফার্মেসিতে ফার্মেসিতে ঘুরি, এমনকি কখনও কারও বাড়িতে যাই যদি শুনি সেখানে ওষুধ থাকতে পারে।”
গাজার আল হেলু আন্তর্জাতিক হাসপাতালের অনকোলজি বিভাগের জরুরি প্রধান সাঈদ আল-সৌদি জানান, “অনেক রোগী জরুরি ওষুধ পাচ্ছে না। ফলে তাদের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ছে এবং অনেক সময় তা প্রাণঘাতী হতে পারে।”
ফার্মাসিস্ট রানা আলসামাক বলেন, “মল্টিপল স্ক্লেরোসিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, হেপাটাইটিস, দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা ও ইমিউন-সম্পর্কিত রোগের চিকিৎসা কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের ‘মানবিক তহবিল’ পরিকল্পনায় জাতিসংঘের আপত্তি
এমন পরিস্থিতিতে, যুক্তরাষ্ট্র ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ নামে একটি উদ্যোগের ঘোষণা দিয়েছে, যার মাধ্যমে সহায়তা পাঠানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে — ইসরায়েলি সামরিক নিরাপত্তা তত্ত্বাবধানে।
তবে জাতিসংঘ এই পদক্ষেপকে স্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে, জানিয়ে দিয়েছে এটি মানবিক সহায়তার নিরপেক্ষতা নষ্ট করবে এবং গণবিস্থাপন ঘটাতে পারে।
গাজার ২৩ লাখ মানুষ যখন ক্ষুধা, রোগ ও নিরাপত্তাহীনতায় নিপতিত, তখন আন্তর্জাতিক চাপ বাড়লেও বাস্তবিক পরিবর্তনের কোনো আশাবাদী সঙ্কেত এখনও দেখা যাচ্ছে না।
Leave a Reply