গাজায় আবারও তীব্র বোমাবর্ষণ চালিয়েছে ইসরায়েল। শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) দিনভর হামলায় কমপক্ষে ৫৩ জন নিহত হয়েছেন। ধ্বংস করা হয়েছে ১৬টি ভবন, যার মধ্যে তিনটি আবাসিক টাওয়ারও রয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, হামলার পাশাপাশি ক্ষুধা ও অপুষ্টিজনিত কারণে আরও দু’জনের মৃত্যু হয়েছে। চলমান যুদ্ধ শুরুর পর থেকে কেবল ক্ষুধায় এখন পর্যন্ত ৪২২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।
গাজা সিটির রিমাল এলাকার আল-কাওসার টাওয়ারকে লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেটি মিসাইল হামলায় ধ্বংস করে ইসরায়েলি বাহিনী। অবিরাম বোমাবর্ষণে হাজার হাজার মানুষ পালাতে বাধ্য হচ্ছেন।
একজন বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি মারওয়ান আল-সাফি বলেন,
“আমরা জানি না কোথায় যাব। আমরা এখানে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছি।”
গাজা সরকারের গণমাধ্যম অফিস ইসরায়েলের এই হামলাকে “নিয়মিত গণবিধ্বংস ও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির নীতি” বলে অভিহিত করেছে। বিবৃতিতে জানানো হয়, ইসরায়েল দাবি করলেও বাস্তবতা হলো তারা নির্বিচারে স্কুল, মসজিদ, হাসপাতাল, মানবিক সংস্থার অফিস ও আবাসিক ভবনগুলোতে হামলা চালাচ্ছে।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা (UNRWA)-এর প্রধান ফিলিপ লাজারিনি এক্স-এ পোস্ট করে জানান, শুধু গত চার দিনেই গাজা সিটিতে সংস্থার ১০টি ভবনে হামলা হয়েছে, যার মধ্যে সাতটি স্কুল ও দুটি ক্লিনিক রয়েছে। তিনি লিখেছেন—“গাজায় কোথাও নিরাপদ নয়। কেউ নিরাপদ নয়।”
তীব্র বোমাবর্ষণের মধ্যে পরিবারগুলো দক্ষিণাঞ্চলের আল-মাওয়াসি এলাকায় পালিয়ে যাচ্ছে, যেটিকে ইসরায়েল তথাকথিত “নিরাপদ অঞ্চল” ঘোষণা করেছিল। কিন্তু বাস্তবতায় সেখানেও হামলা হচ্ছে এবং পরিস্থিতি ভয়াবহ।
বাস্তুচ্যুত আহমেদ আওয়াদ আল জাজিরাকে বলেন, “উত্তর গাজা থেকে মর্টার শেলের বৃষ্টির মধ্যে আমরা পালাই। মধ্যরাতে এখানে এসে দেখি পানি নেই, টয়লেট নেই, খোলা আকাশের নিচে পরিবারগুলো ঘুমাচ্ছে।”
আরেকজন ফিলিস্তিনি, আবদুল্লাহ আরাম জানান, “খাবার নেই, পানি নেই। শীত আসছে কিন্তু পর্যাপ্ত তাঁবুও নেই। আমাদের পরিবার ক্ষুধা ও রোগে কষ্ট পাচ্ছে।”
ইউনিসেফের মুখপাত্র টেস ইনগ্রাম জানান, আল-মাওয়াসির পরিস্থিতি প্রতিদিনই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। তিনি বলেন, “গাজায় কোনো জায়গাই নিরাপদ নয়, এমনকি এই তথাকথিত মানবিক অঞ্চলও না।”
এদিকে গত সপ্তাহে কাতারে হামাস নেতাদের ওপর ইসরায়েলি হামলায় পাঁচ হামাস সদস্য ও এক কাতারি নিরাপত্তাকর্মী নিহত হওয়ার পর রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বেড়েছে।
দোহায় আরব ও ইসলামী দেশগুলোর জরুরি বৈঠকে অংশ নিয়ে নেতারা ইসরায়েলকে “গণহত্যা, জাতিগত নিধন, অবরোধ ও উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার” অভিযোগে নিন্দা জানান।
কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান আল থানি ইসরায়েলের ওই হামলাকে “বর্বরোচিত” আখ্যা দিয়ে দৃঢ় প্রতিক্রিয়ার আহ্বান জানান।
আরব লীগের মহাসচিব আহমেদ আবুল গেইথ বলেন, “আন্তর্জাতিক নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তা ইসরায়েলকে আরও সাহসী করে তুলেছে। এখনই তাদের যুদ্ধাপরাধের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।”
কাতারে হামলার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের অস্বস্তি থাকলেও সম্পর্ক অটুট রয়েছে বলে দাবি করেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। জেরুজালেমে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, “আমাদের সম্পর্ক পশ্চিমা প্রাচীরের পাথরের মতোই দৃঢ়।”
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হামলায় অসন্তুষ্ট বলে জানিয়েছেন রুবিও। যদিও তিনি জোর দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্ক এখনও “অত্যন্ত শক্তিশালী”।
অন্যদিকে, ইসরায়েলি মন্ত্রীরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, হামাস নেতারা পৃথিবীর কোনো জায়গায়ই নিরাপদ নয়।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত ৬৪,৮৭১ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছেন ১,৬৪,৬১০ জন। অপরদিকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশটির ২০ হাজারেরও বেশি সেনা আহত হয়েছে, যাদের অর্ধেকই মানসিক ট্রমায় ভুগছে। ২০২৮ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
Leave a Reply