রাশিয়ার সঙ্গে চার বছর ধরে চলমান যুদ্ধে একটি সমঝোতা টানতে যুক্তরাষ্ট্র যখন কিয়েভের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে, ঠিক তখনই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে চলেছেন। ওয়াশিংটনের প্রস্তাবিত সংশোধিত শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে ইউক্রেনের উদ্বেগও বাড়ছে, কারণ রাশিয়া ইঙ্গিত দিয়েছে—পরিকল্পনাটি তাদের কাঙ্ক্ষিত অনেক দিকই পূরণ করছে।
সোমবার লন্ডনে ব্রিটিশ, ফরাসি ও জার্মান নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসবেন জেলেনস্কি। বৈঠকে প্রতিরক্ষা, নিরাপত্তা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সংশোধিত শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হবে। জেলেনস্কি বলেন, আলোচনায় যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের তাৎক্ষণিক নিরাপত্তা প্রয়োজন ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন—দুই বিষয়ই গুরুত্ব পাবে।
এরপর তিনি ব্রাসেলসে ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুটে, ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রধান আন্তোনিও কস্তা এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লাইয়েনের সঙ্গে বৈঠক করবেন। ইউরোপীয় নেতাদের মধ্যে শঙ্কা বাড়ছে—যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি পরিকল্পনা ইউক্রেনকে মানতে বাধ্য করতে চাইছে যা কিয়েভের জন্য প্রতিকূল হতে পারে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে যুদ্ধের ‘চূড়ান্ত মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন এবং তার অবস্থান রাশিয়ার বয়ানের সঙ্গে বেশ মিলছে বলে ইউক্রেনে ধারণা তৈরি হয়েছে। গত মাসে ফাঁস হওয়া ট্রাম্প শিবিরের ২৮ দফা শান্তি পরিকল্পনাকে অনেকেই অভিহিত করেছিলেন “রাশিয়ার ইচ্ছাপূরণ তালিকা” হিসেবে।
এর পর ইউক্রেন ইউরোপীয় মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে নতুন একটি প্রস্তাব তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রকে দেয়।
তবে সেই পরিকল্পনা নিয়েই এখন জটিলতা তৈরি হয়েছে।
ট্রাম্পের দূত স্টিভ উইটকফ ও জামাই জ্যারেড কুশনার গত সপ্তাহে সংশোধিত শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে মস্কো গিয়েছিলেন। পরে তারা মায়ামিতে কয়েকদিন ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন—কোনো অগ্রগতি ছাড়াই আলোচনা শেষ হয়।
সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে—ইউক্রেনকে পূর্বাঞ্চলীয় দনবাস অঞ্চল রাশিয়াকে ছেড়ে দিতে হবে—যা বর্তমানে রাশিয়ার অবৈধ দখলে থাকলেও সম্পূর্ণ দখলে নেই। ব্লুমবার্গকে দেওয়া মন্তব্যে জেলেনস্কি বলেন, পরিকল্পনাটিতে এখনও “সংবেদনশীল বিষয়” রয়েছে—বিশেষ করে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা এবং পূর্বাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ।
তিনি বলেন, “আমাদের, যুক্তরাষ্ট্রের ও রাশিয়ার দনবাস নিয়ে একক কোনো মত নেই।”
ইউক্রেন পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে পৃথক নিরাপত্তা চুক্তিরও দাবি করেছে।
ট্রাম্প আগে থেকেই জেলেনস্কিকে দনবাস ছেড়ে দিতে না চাওয়ার জন্য ভর্ৎসনা করেছেন। ইউক্রেন ও তার ইউরোপীয় অংশীদাররা এই প্রস্তাব স্পষ্টভাবেই প্রত্যাখ্যান করেছে।
রবিবার ট্রাম্প দাবি করেন—জেলেনস্কি নাকি পরিকল্পনাটি ঠিকমতো পড়েননি।
তিনি বলেন, “রাশিয়া এতে রাজি, কিন্তু জেলেনস্কি রাজি কি না জানি না। তার জনগণ এটা চায়, কিন্তু সে প্রস্তুত নয়।”
প্রায় চার বছরের যুদ্ধে এটি ইউক্রেনের অন্যতম কঠিন সময়। পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ার অগ্রযাত্রা, ধারাবাহিক আক্রমণ এবং বারবার বিদ্যুৎ বিপর্যয় জনজীবনকে বিপর্যস্ত করছে। জেলেনস্কি মায়ামির আলোচনা “গঠনমূলক হলেও কঠিন” বলে বর্ণনা করেছেন।
ইউক্রেনের প্রধান আলোচক রুস্তেম উমেরভ বলেন, তিনি জেলেনস্কিকে পুরো প্রক্রিয়ার অগ্রগতি জানাবেন এবং শান্তি পরিকল্পনা সংক্রান্ত সব নথি হস্তান্তর করবেন। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন—তারা চুক্তির প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন। কিন্তু ইউক্রেন বা রাশিয়া—কেউ-ই এখনো কোনো শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে আগ্রহী দেখাচ্ছে না।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও এখন পর্যন্ত এই পরিকল্পনা নিয়ে সুস্পষ্ট সমর্থন জানাননি। বরং তিনি বলেছেন—পরিকল্পনার কিছু দিক “অকার্যকর”। যদিও পুরো নথিটি রাশিয়ার পক্ষে ঝুঁকে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে ট্রাম্প প্রশাসনের সদ্যপ্রকাশিত জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলকে মস্কো স্বাগত জানিয়েছে, কারণ সেটি রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সেই নথিতে ইউরোপ “সভ্যতার মুছে যাওয়ার” ঝুঁকিতে রয়েছে বলে সতর্ক করা হয়েছে এবং ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধকে যুক্তরাষ্ট্রের “মূল স্বার্থের” বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া মস্কোর সঙ্গে “কৌশলগত স্থিতিশীলতা” পুনরুদ্ধারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.